ফানি ভিডিওতে মিঠুনের বাজিমাত, মাসে আয় ২ লাখ
ইউটিউবে ফানি ভিডিও দেখিয়ে বাজিমাত করেছেন নওগাঁর প্রত্যন্ত এলাকার মতিউর রহমান মিঠুন (৩২)। তার ভিডিওতে আলাদা কিছু শব্দ থাকলেও কোনো কথা নেই। অঙ্গভঙ্গি দেখেই মানুষ মজা পায়।
ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন মিঠুন। পাশাপাশি এলাকার ৭০ জন বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। মাস্তি করেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইউটিউব চ্যানেলের স্বপ্ন দেখেন এই যুবক।
প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণ-তরুণীরা হাসি-ঠাট্টা, আড্ডা-মাস্তি আর সঙ্গে কিছু মজাদার কর্মকাণ্ড সংযুক্ত করে ভিডিও তৈরি করেন। প্রতিটি ভিডিও ৫ থেকে ৮ মিনিট। এভাবেই মানুষকে প্রতিনিয়ত আনন্দ দিয়ে আসছে মাহা ফান টিভি (Maha Fun Tv)। শুক্রবার (৪ মে) পর্যন্ত তার চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার ছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ।
জানা গেছে, জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের ঈশ্বরদেবত্বর গ্রামের যুবক মতিউর রহমান মিঠুন। বাবা রজব আলী একজন কৃষক এবং মা মেহেরুন নেছা একজন গৃহিণী। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক ছেলে সন্তানের বাবা।
নিয়ামতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগ থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি এবং নিয়ামতপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি ও ২০১৭ সালে মানবিক বিভাগ নিয়েই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
পড়াশুনা শেষ করে চাকরির জন্য গিয়েছিলেন ওষুধ কোম্পানিতে। চাকরি না হয়ে হতাশ মনে গ্রামে ফিরে আসেন। ২০১৭ সালে স্যামস্যাং জে-২ মোবাইল ফোন কেনার সময় ২ জিবি মেগাবাইট ফ্রি দেওয়া হয়। সেই এমবি দিয়ে ইন্টারনেটে বিভিন্ন ফানি ভিডিও দেখেন মিঠুন। ভিডিওগুলো দেখে বন্ধু মিজানুর রহমানে সঙ্গে পরামর্শ করে ভিডিও তৈরর সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে শুরু হয় ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানানো।
ভিডিও ধারণ ও এডিটিং তিনি নিজেই করতেন। রাত জেগে এডিটিং শিখতেন ইউটিউবেরই ভিডিও দেখে। তার ভিডিওতে কোনো কথা নেই। কিন্তু তারপরও অঙ্গভঙ্গি দেখেই মানুষ মজা পায়। নিজের চ্যানেলে কিছু ভিডিও দেওয়ার পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ইউটিউব থেকে প্রথমবার আট হাজার টাকা আয় করেন। এরপরই ভিডিও বানানোর ঝোঁক বেড়ে যায়। ইন্টারনেটে ভিডিও দেখে দেখে তার হাতে খড়ি। বলা যায় তিনি এখন পুরোদস্তুর পেশাদার নির্মাতা।
ধীরে ধীরে তার দল বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। তিনি ভিডিওর পরিচালক। তার সঙ্গে ৭০ জন তরুণ-তরুণী কাজ করে। যেখানে অভিনেতা আছে ৩০ জন। বাকিরা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে থাকে। সবাই বেতনভুক্ত। প্রতিজন ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন।
শুরুতে শুধু ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভিডিও তৈরি করতেন। পরে দেখলেন, তার তৈরিকৃত ভিডিও বিভিন্ন ফেসবুক পেজে আপলোড করে অন্যরা সেখান থেকে আয় করছে। এরপর তিনি ফেসবুকে পেজ খোলেন এবং সেখান থেকেও আয় করছেন।
এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঈশ্বরদেবত্বর গ্রাম। যেখানে ইউটিউবে ভিডিও তৈরির জন্য নিজস্বভাবে মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পৃথক দুটি বাড়ি। সামনে দেওয়া হয়েছে বেড়া। যেখানে বিভিন্ন রঙ করে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। চারকক্ষ বিশিষ্ট ইটের আধাপাকা বাড়িও তৈরি করা হয়েছে। ছোট পুকুর খনন করা হয়েছে। এছাড়া রাস্তার দুই পাশে থাকা গাছগুলো রঙ করা হয়েছে। অভিনেতারা যে যার মতো অঙ্গভঙ্গির অভিনয় করা নিয়ে ব্যস্ত।
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠে-ঘাটে এসব ভিডিও ধারণ করা হয়। মিঠুন নিজের মতো করে স্ক্রিপ লেখেন। পরে সে অনুযায়ী ভিডিও তৈরি করা হয় বলে জানান তিনি।
ভিডিওতে নানা জিনিস ভেঙে চুরমার করতে দেখা যায়। মাঠে ঘাটে এসব করতে দেখে গ্রামের লোকেরা এক সময় তাকে পাগল বলতেন। গ্রামবাসীরা তাকে বখাটেও বলতেন। পরে তার দলবল নিয়ে দূরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শুটিং করতে হয়েছিল। এখন গ্রামের সবাই তাকে সহযোগিতা করেন। মিঠুন সামাজিক বিভিন্ন কাজেও যুক্ত আছেন।
ইউটিউবে বাজিমাত করা মতিউর রহমান মিঠুন বলেন, পড়াশুনা শেষ করে একটি ওষুধ কোম্পানিতে সেলসম্যান হিসেবে চাকরির জন্য গিয়েছিলাম। বেতন ৫-৭ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু তারা আমাকে গ্রহণ করেনি। ব্যাগ নিয়ে ওষুধ বিলি করবো, সেখানে আমার চাকরি না হওয়ায় মনোক্ষুণ্ন হয়ে বাড়ি ফিরলাম। ভাবলাম আমার দ্বারা আর কিছু হবে না।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে স্যামস্যাং জে-২ ফোন কিনেছিলাম। তখন ২ জিবি মেগাবাইট ফ্রি দেওয়া হয়েছিল। তা কিভাবে শেষ করবো বুঝছিলাম না। পরে ইন্টারনেটে দেখি মজার মজার ফান ভিডিও। ভিডিওগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম কিভাবে ভিডিও তৈরি করে আয় করা যায়। এমন ধারণা থেকেই মোবাইল দিয়ে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ভিডিও তৈরি শুরু করলাম। প্রথম ভিডিও ছিল পুকুর পাড়ে পানির ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে একজন, পেছনে আরেকজন এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেবে। গ্রামে এসব করলে মানুষ খারাপ বলবে। এজন্য গ্রামের বাইরে গিয়ে ভিডিও তৈরি করেছিলাম।
পরে ‘এসডি ফানি ভিডিও বিডি’ চ্যানেল খুলে সেখানে আপলোড করতাম। বন্ধুদের ফোনে এমবি কিনে দিয়ে এক হাজার সাবস্ক্রাইব এবং ওয়াচ টাইম পূরণ করলাম। এতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যায় বলেও জানান তিনি।
মনিটাইজেশনের (নগদীকরণ) সমস্যা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল জানিয়ে মিঠুন বলেন, মনিটাইজেশনের আবেদন করা হলেও ইউটিউব তা গ্রহণ করেনি। চ্যানেলে কিছু ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করে পুণরায় আবেদন করতে বলা হয়। এভাবে আরো ছয়মাস পেরিয়ে যায়। এ ছয়মাসে চ্যানেলটিতে সাবস্ক্রাইবার দাঁড়ায় তিন লাখ। যেহেতু মনিটাইজেশন হচ্ছে না, পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইনডেক্স স্ক্রিনে ভিউ সেল করার। সেখান থেকেও আয় আসা শুরু হয়। একদিন বাবাকে বললাম একটি ইউটিউব চ্যানেল বিক্রি হবে তা কেনার জন্য কিছু টাকার প্রয়োজন। টাকা তো দিলো না, উল্টো বকাঝকা শুরু করলো। যেহেতু আমি ইনডেক্স স্ক্রিনে ভিউ সেল করে আয় করতাম তা দিয়ে বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ বাজার করে দিলাম। পরে বাবা নিজ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিলেন। ওই টাকা দিয়ে মনিটাইজেশন করা ‘মাহা ফানি টিভি’ চ্যানেলটি কিনলাম ২০১৭ সালে। এরপর থেকে এ চ্যানেলে ভিডিও আপলোড করা শুরু করলাম।
মিঠুন বলেন, এক সময় ‘এসডি ফানি ভিডিও বিডি’ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে ইউটিউব থেকে ফানি ভিডিও বন্ধ করে দেয়। পরে আবারও চালু হয়। বর্তমানে ‘বিজি ফান টিভি’ ও ‘মাহা ফান টিভি’ এ দুটো ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল আছে। ‘বিজি ফান টিভি’ তে সাবস্ক্রাইব আছে প্রায় ১০ মিলিয়ন। প্রতি মাসে গড়ে পাঁচটি ভিডিও আপলোড করা হয়।
তিনি বলেন, ভিডিও এডিটিং রাত জেগে নিজেই করি। এক সময় এলাকার মানুষ আমাকে পাগল বললেও এখন আর কিছু বলে না। আমার চ্যানলে প্রায় ৭০ জন বেকার তরুণ-তরুণী কাজ করে। যাদের বেতন প্রায় ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে প্রায় ২ লাখ টাকা আয় হয়। মাস্তি করেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইউটিউব চ্যানেলের স্বপ্ন দেখি আমি।
উপজেলার রাজাপুর গ্রামের অর্নাস প্রথম বর্ষে ছাত্র ফায়সাল হোসেন। গত চার বছর থেকে এই টিমে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছি। শুরুর দিকে বেতন কম হলেও বর্তমানে ২০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছি। বলা চলে এখানে ফুল টাইম হিসেবে কাজ করা।
এক সময় মাইক্রো চালাতেন যুবক আরিফ হোসেন। তখন ৮ হাজার টাকা বেতন পেতেন। ইউটিউবের এ টিমে গত তিন বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। শুটিংয়ে কী কী লাগবে তা সংগ্রহ করা এবং কাজের তদারকি করাই তার কাজ।
তিনি বলেন, রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হতো। কিন্তু ইউটিউবের এ টিমে কাজ করে বেতন যা পাই আলহামদুলিল্লাহ। পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার ভালোভাবে চলে যাচ্ছে।
ঈশ্বরদেবত্বর গ্রামের মোফাজ্জল হোসেন বলেন, মতিউর রহমান মিঠুনের কার্যক্রমে এক সময় গ্রামবাসী তাকে পাগল বলতো। কিন্তু মানুষের সে ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তার ওখানে এলাকার অনেক বেকারদের কর্মসংস্থান হয়েছে। এলাকার সামাজিক বিভিন্ন কাজে সে সহযোগিতা করে থাকে। এখন গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে গর্ব করে।
মতিউর রহমান মিঠুনের বাবা রজব আলী বলেন, শুরুর দিকে ছেলের কার্যক্রম দেখে বিরক্ত লাগতো। তাকে অনেক বকাঝকা করেছি এসব পাগলামি না করে অন্য কোনো কাজ করার জন্য। ভিডিও করতে গিয়ে বিভিন্ন ভাঙচুর করে। এসব কাজ দেখে মানুষও তাকে পাগল বলতো। ছেলেকে সহযোগিতা করতে চাইতাম না। পরে যখন দেখলাম ভিডিও থেকে আয় হচ্ছে, তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলাম। বলা চলে ছেলে এখন এলাকার গর্ব।
এফএ/এমএস