১৪ বছর ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি জয়পুরহাট
প্রকাশিত: ০৫:৪৯ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০২২
আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটার

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ঠিকানা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র একজন। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে।

ফলে বাধ্য হয়ে উপজেলাবাসীকে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে ধরনা দিতে হয় জয়পুরহাট সদরসহ ও পাশের বগুড়া জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে। এদিকে, আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।

আক্কেলপুর উপজেলার একটি পৌরসভাসহ পাঁচ ইউনিয়নের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৭৫ সালে স্থাপিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। শুরুর ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করাসহ আধুনিক হাসপাতাল ভবন নির্মিত হয় ২০০৬ সালে। সেই সময় থেকেই অপারেশন করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় একটি সুসজ্জিত রুমসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। এছাড়া সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য দেওয়া হয় সোলার সিস্টেম। শুরুতে কিছুদিন রোগীর অপারেশন চলার পর ২০০৮ সাল থেকে চিকিৎসক ও লোকবলের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও আর চালু করা সম্ভব হয়নি অপারেশন থিয়েটারটি। দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন থিয়েটার কক্ষটি ব্যবহার না করায় এর যন্ত্রপাতি অকেজো হওয়াসহ বৃষ্টির পানি ছাদ দিয়ে পড়ার কারণে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্স থাকলেও গাইনি ও সার্জারি চিকিৎসকের অভাবে কোনো অপারেশন করানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ২০০৬ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যা হওয়ার পর অপারেশন থিয়েটারে টিউমার, ফোঁড়া, অর্থোপেডিকসসহ বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি অপারেশন নামমাত্র সরকারি ফি নিয়ে করা হতো। এতে করে কেবল আক্কেলপুর উপজেলা নয়, পাশের বিভিন্ন উপজেলার রোগীরা এ হাসপাতালে ভিড় করতেন। কিন্তু অপারেশন বন্ধ থাকায় দরিদ্র রোগীদের নানা ভোগান্তির শিকার হওয়াসহ গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। এ সুযোগে ফায়দা লুটছেন বেসরকারি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।

১৪ বছর ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে গাইনি, মেডিসিন, শিশু, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিকস, সার্জারি, চর্ম ও যৌন, চক্ষু, নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞসহ ১১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কেবল একজন অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া বাকি সব পদ খালি। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৮৫টি পদের মধ্যে ৫২ জন কর্মরত আছেন।

সরেজমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও অন্তঃবিভাগে চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের মিলছে না ওষুধ। ফলে রোগীদের বাইরে থেকে কিনে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এছাড়া এক্স-রে যন্ত্র পুরোনো হওয়ায় রোগীদের বাইরে যেতে হচ্ছে। হাসপাতালে বাথরুমগুলো নোংরা, রোগীর বেডের পাশেই রাখা হয়ে ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ও স্যালাইনের খালি প্যাকেট। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতর যত্রতত্র অটোরিকশা পার্কিং করে রাখা হয়েছে।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের ১২ বছরের নাঈম হোসেনের বাবা আফজাল হোসেন বলেন, ছেলের প্রশাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এনেছিলাম। চিকিৎসাপত্রে অন্য ওষুধ না পেলেও কেবল প্যারাসিটামল পেয়েছি।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উপজেলার জাফরপুর গ্রামের দুই বছরের শিশু আবদুল্লাহর অভিভাবক আবেদ আলী বলেন, কেবল হাসপাতাল থেকে এক ছিপি করে ওষুধ ও স্যালাইন দিচ্ছে। বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

১৪ বছর ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

পাশের নওগাঁ জেলার খাদাইল গ্রামের মো. আলী বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীরা যেমন প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি চিকিৎসকদেরও সীমাবদ্ধতার মধ্যে যথার্থ সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আক্কেলপুরের বিহারপুর গ্রামের সাজেদা বেগমের সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়েছে জয়পুরহাট শহরে। স্বল্প আয়ের মানুষ হলেও তার অপারেশনে খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা।

সাজেদার মা রওশন আরা বলেন, আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশনের ব্যবস্থা থাকলে এত অর্থ খরচ করতে হতো না। এছাড়া, একই কথা জানান মওদুদ আহম্মেদ। তার স্ত্রীকে সিজারিয়ান অপারেশন করান জয়পুরহাটের একটি ক্লিনিকে। ওখানে ওষুধ, বেড ভাড়া আর চিকিৎসক বাবদ খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।

আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. এনায়েত হোসেন বলেন, আমি এই হাসপাতালে ২০১৩ সালে জয়েন করেছি। তবে এর আগে ২০০৮ সাল থেকেই অপারেশন থিয়েটারটি বন্ধ আছে।

১৪ বছর ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

এ বিষয়ে আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রুহুল আমিন বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে দশটি পদই শূন্য। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তিনি যোগদান না করে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে গাইনি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞর অভাবে বহুদিন ধরে সব ধরনের অপারেশন বন্ধ রয়েছে। এসব পদে চিকিৎসক পদায়ন করা হলে আমরা অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে কর্মরত তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়ে হাসপাতালটি পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এছাড়া বাজারের মধ্যে হাসপাতাল হওয়ায় বাইরের লোকজন এসে বাথরুম নোংরা করে যায়। আর গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলো ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে।

জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ আলী বলেন, চিকিৎসক পদায়নের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। তবে দ্রুত গাইনি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে অপারেশন চালু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানালেন এই কর্মকর্তা।

রাশেদুজ্জামান/এমআরআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।