অনিয়মের দাপটে মৃত্যুপুরী শীতলক্ষ্যা
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন অনিয়মনের দাপটে এখানকার তীরে কয়েকদিন পরপরই জমে মরদেহের মিছিল। স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যার পাড়। কিন্তু এসব যেন দেখার কেউ নেই।
১২ মাসে গিলেছে ৫৮ প্রাণ
গত বছরের ৪ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ ও ট্রলারডুবিতে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সবশেষ গত ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর চর সৈয়দপুর আল আমিন নগর এলাকায় রূপসী-৯ নামে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এম এল আশরাফ উদ্দিন নামে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। এই ঘটনায় ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধারকৃতরা হলেন মুন্সিগঞ্জের মুসলেহ উদ্দিন হাতেম (৫০), ডেমরার আব্দুল্লাহ আল জাবের, সোনারগাঁও হরিয়ান প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা উম্মে খাইরুন ফাতিমা (৪০), মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুর এলাকার জয়নাল ভূঁইয়া (৫০), রমজানবেগ এলাকার আরিফা (৩৫), তার শিশু সন্তান সাফায়েত হোসেন (দেড় বছর), গজারিয়া উপজেলার ইস্পাহানিচর স্মৃতি রাণী বর্মণ ও তার বোন আরোহী, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের আজিজের মেয়ে সালমা (৩৩), একই এলাকার ইউনুস খলিফার মেয়ে ফাতেমা (৭) ও একজন অজ্ঞাত।
এর আগে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা ধর্মগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীতে মেসার্স ফারহান নেভিগেশনের এমভি ফারহান-৬ লঞ্চের ধাক্কায় ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতরা হলেন- কিশোরগঞ্জের ইদ্রিস আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ, রেকমত আলীর ছেলে মোতালেব, চর বক্তাবলী এলাকার রাজুর ছেলে সাব্বির, মধ্য চরের সোহেলের স্ত্রী জেসমিন আক্তার, সোহেলের ছেলে তামীম খান, মেয়ে তাফসিয়া, তাসমিম ওরফে তাসলিমা, আওলাদ, মো. শামসুদ্দিন ও জোসনা বেগম।
তার আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের লঞ্চ টার্মিনাল থেকে অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী ‘এমভি সাবিত আল হাসান’ নামে লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় সদর উপজেলার সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে পেছন থেকে এসে ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামে একটি কার্গো জাহাজ ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে পালিয়ে যায়। একে ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতরা সকলেই মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা।
তারা হলেন- রুনা আক্তার (২৪), সোলেমান ব্যাপারী (৬০), বেবী বেগম (৬০), সুনিতা সাহা (৪০), পখিনা বেগম (৪৫), বিথী (১৮), অরিফ (১), প্রতিমা শর্মা (৫৩), শামসুদ্দিন (৯০), রেহেনা বেগম (৬৫), হাফিজুর রহমান (২৪), তহমিনা (২০), আব্দুল্লাহ (১), নারায়ণ দাস (৬৫), পার্বতী রানী দাস (৪৫), আজমীর (২), শাহআলম মৃধা (৫৫), মহারাণী (৩৭), আনোয়ার হোসেন (৫৫), মাকসুদা বেগম (৩০), সাউদা আক্তার লতা (১৮), আব্দুল খালেক (৭০), জিবু (১৩), খাদিজা বেগম (৫০), মোহাম্মদ নয়ন (২৯), সাদিয়া আক্তার (৭), বিকাশ সাহা (২২), মানসুরা (৭ মাস), অনিক সাহা (১২), জাকির হোসেন (৪৫), তানভীর হোসেন হৃদয়, রিজভী (২০), মো. ইউসুফ কাজী ও মো. সোহাগ হাওলাদার (২৩)।
এছাড়াও গত ৫ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর ঘাটে বাল্কহেডের ধাক্কায় দুইটি নৌকা ডুবে যায়। এতে নৌকার যাত্রীরা সকলে নদীতে পড়ে যায়। এর দুদিন পর রাহিমা নামে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
গত বছরের ৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া নোয়াপাড়া ঘাটে শীতলক্ষ্যা নদীতে ২০ জন যাত্রীসহ নৌকাডুবির ঘটনায় চিস্তি ও জোবেদা নামে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
ঘটনার পরই হয় মামলা
এসব দুর্ঘটনা ঘটার পরই মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলার বাদী হয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নৌ নিরাপত্তা বিভাগের উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাবু লাল বৌদ্ধ।
গত ২০ মার্চ শীতলক্ষ্যার আল আমিন নগর এলাকায় লঞ্চডুবির ঘটনায় গত ২১ মার্চ নৌ নিরাপত্তা উপপরিচালক বাবু লাল বৌদ্ধ বাদী হয়ে পৃথক দুইটি মামলা করেছেন। একটি মামলা করেছেন নৌ-আদালতে আরেকটি বন্দর থানায়। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে- কার্গো জাহাজের প্রথম শ্রেণির মাস্টার রমজান আলী, ২য় শ্রেণির মাস্টার নুরুল আলম, ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম ও মো. নাদিম হোসেন, লস্কর সুমন হোসেন ও ইয়াছিন মিয়া, গ্রীজার রিয়াদ হোসেন ও সুকানী জাহিদুল ইসলামকে।
একইসঙ্গে ফতুল্লার ধলেশ্বরী নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় গত ৬ জানুয়ারি বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নৌ নিরাপত্তা বিভাগের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাবু লাল বৈদ্য বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। যে মামলায় আসামি করা হয় মেসার্স ফারহান নেভিগেশনের এমভি ফারহান-৬ নামক লঞ্চের মাস্টার কামরুল হাসান (৪০), ইনচার্জ ড্রাইভার মো. জসিম উদ্দিন ভুইয়া (৪০) ও সুকানি মো. জসিম মোল্লাকে (৩০)।
গত বছরের ৪ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকার ঘটনায় ৬ এপ্রিল রাতে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাবু লাল বৈদ্য বাদী হয়ে বন্দর থানায় মামলা করেন। মামলায় হত্যার উদ্দেশে বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী জাহাজ চালিয়ে লঞ্চটি ডুবিয়ে ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে মামলায় আসামি হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
মামলার বাদী বাবু লাল বৈদ্য জানিয়েছিলেন, পেনাল কোড ২৮০, ৩০৪, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৩৭ ধারাসহ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ এর ৭০ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশে ও বেপরোয়া গতিতে নৌযান চালিয়ে ৩৪ জনকে হত্যা সংঘটিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু মামলায় আসামি হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
‘ম্যানেজড’ মামলা
এসকল মামলাকে ‘ম্যানেজ’ মামলা হিসেবে দাবি করেছেন বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতি নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি বদিউজ্জামান।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীতে যে ৫টি লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে তাতে প্রথমে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। প্রতিটি মামলাতেই জাহাজের মালিকপক্ষকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে তারা ‘ম্যানেজড’ হয়েই মামলা দায়ের করেছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে নদীর প্রশস্ততা কমে যাওয়া এবং নদীর উভয় তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য কলকারখানার জাহাজগুলো এলোপাথাড়ি পার্কিং। সেইসঙ্গে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচলও অনেক বেড়েছে। কিন্তু নদীতে ট্রাফিক কন্ট্রোল চালু হয়নি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সব দোষ শুধুমাত্র লঞ্চ চালক, শ্রমিক ও মালিকদের উপর চাপানো হয়। এ সকল দুর্ঘটনায় যে সকল বড় বড় জাহাজগুলো দায়ী থাকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। সকল দুর্ঘটনাই কিছু বড় জাহাজের ধাক্কায় ঘটেছে। সবাইকে ডিঙ্গিয়ে বিআইডব্লিটিএ একটা ম্যানেজ মামলা করে থাকে। আমাদের কথা কেউ বুঝে না। আমাদের সুযোগ দিলে আমরা আধুনিকায়ন হতে চাই।
মামলায় আইনের ফাঁক ফোকড়
প্রতিটি নৌদুর্ঘটনায় মামলা হলেও সেখানে থেকে যাচ্ছে আইনের ফাঁক কিংবা দুর্বল ধারা। ফলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু জাগো নিউজকে বলেন, এ সকল ঘটনার পর যে মামলা করা হয় সেখানে ধারাগুলো দেওয়া হয় খুবই দুর্বল। এই ধারাগুলোর সাজা সর্বোচ্চ কয়েক বছরের জেল অথবা কয়েক হাজার টাকা জরিমানা। সেই সঙ্গে মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয় না। ফলে মামলাগুলোর শুরুতেই আইনের ফাঁকফোকড় থেকে যায়। যিনি মামলার বাদী হয়ে থাকেন তিনি জেনে অথবা না জেনেই মামলা করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রাখেন।
তিনি আরও বলেন, ক্ষেত্র বিশেষ একেক আইন থাকে। যেকোনো যানবাহন চালাতে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ রকম কঠিন ধারায় মামলা করে যদি দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া যায় তাহলে এটার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যদি আইনে কোনো দুর্বলতা থাকে সেই আইনতো পরিবর্তন করা যায় না। যুগের প্রয়োজনে দেশের প্রয়োজনে মানুষের প্রয়োজনে বারবার আইন পরিবর্তন হয়েছে।
টাকা দিয়ে জীবনের মূল্য নির্ধারণ
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় ‘এসকেএল-৩’ নামের কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবির পর ৩৪ জন নিহতের স্বজনদের মধ্যে ৩০ জনের পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে তাতে লেখা হয় ‘পরিবারের আর কোনো দাবি দাওয়া নেই এমন অনাপত্তির কথা।’
নিহত অপর ৪ জনের পরিবার এই টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
পরে ২৩ মে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবীরের আদালত জাহাজটি ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে মালিকের কাছে হস্তান্তরের আদেশ দেন। একইসঙ্গে এই মামলায় জামিন পান জাহাজের চালকসহ ১৪ স্টাফ।
তবে এ বিষয়ে মামলার বাদী বাবু লাল বৈদ্য বলেন, সমঝোতা হয়েছে সে বিষয়ে অদ্যবধি আমি কিছু জানি না। আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। আমরা দুর্বল ধারা দিই না। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ধারায় মামলা দায়ের করে থাকি। সেই মামলায় অনেকেই গ্রেফতার হয়ে দিনের পর দিন জেল খাটছে। তারপরও অনেকেই জামিন পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। যার লোক থাকে সে যেকোনোভাবেই হোক পার পেয়ে যায়। আর যার লোক না থাকে সে জেলে থাকে।
ভুক্তভোগীদের পিছুটান
অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, সাধারণত কার্গো জাহাজগুলোর মালিক থাকে প্রভাবশালী লোকজন। আর লঞ্চগুলোতে বেশি চলাচল করে থাকে ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ। তারা একটা পর্যায়ে এসে আইনি লড়াই করার মতো অবস্থায় থাকে না। যারা মূল ভুক্তভোগী থাকে তাদের যদি কোনো ইচ্ছা না থাকে তাহলে এখানে অন্য কারও কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, এখানে যারা কর্তৃপক্ষ আছেস তারা মনে হয় কানে তুলা দিয়ে রেখেছেন। যারা মারা যাচ্ছে তারা কারো ভাই, কারও বোন। তাদের চিৎকার আহাজারি কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছে না। তাদের কঠোর হওয়া উচিত। যেকোনো একটি পক্ষের অবহেলার কারণেই এতগুলো লোকের প্রাণহানি হয়ে থাকে। এটার জন্য কর্তৃপক্ষের নড়েচড়ে বসা উচিত। সঠিক বিচারের জন্য সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত।
মামলার বাদী যা বললেন
বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নৌ নিরাপত্তা বিভাগের উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাবু লাল বৈদ্য জাগো নিউজকে বলেন, এখনও মামলা চলমান অবস্থায় রয়েছে। আমাদের ডাকলে আমরা কোর্টে গিয়ে হাজির হই। কোর্ট যদি ডাকে তাহলেই তো আমরা গিয়ে কোর্টে হাজির হবো। কিন্তু কোর্ট তো আমাকে ডাকে না।
এফএ/এএসএম