খোদ অ্যাম্বুলেন্সই যখন মুমূর্ষু
উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম জেলা দিনাজপুরের প্রত্যন্ত উপজেলা ঘোড়াঘাট। জেলা সদর থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১০২ কিলোমিটার। ফলে জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসাসেবা পেতে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয় এই উপজেলার নাগরিকদের। এর ওপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র একটি অ্যাম্বুলেন্স। ফলে জরুরি মুহূর্তে এটি পেতে জীবন মরণের পরীক্ষায় পড়তে হয় উপজেলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে।
৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও জটিল কোনো সমস্যা হলেই এই উপজেলার মানুষকে যেতে হয় জেলা সদর দিনাজপুরে। সেখানে রয়েছে আধুনিক ও উন্নতমানের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তবে দূরত্ব ও যাতায়াত খরচ বেশি হওয়ায় তারা ছুটে যান পার্শ্ববর্তী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘোড়াঘাট উপজেলা থেকে রংপুর ও বগুড়া জেলার এই দুটি মেডিকেল কলেজের দূরত্ব ৫০-৬০ কিলোমিটার।
উপজেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ১৪৮ দশমিক ৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঘোড়াঘাট উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৪০ জন। গত ১০ বছরে এ সংখ্যা আরও কয়েক হাজার বেড়েছে।
বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এই মানুষগুলোর জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র দুটি। তার মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে একটি অ্যাম্বুলেন্স গত ৮ বছর থেকে দুটি টিনের চালার নিচে নিজেই রোগী হয়ে পড়ে আছে। বাকি সচল একটি অ্যাম্বুলেন্সের আবার নেই চালক। হাসপাতালের মালি বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সটির চালক হিসেবে কাজ করছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য বলছে, এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। তার মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে সাত-আটজন রোগীর অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন পড়ে। তবে একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স থাকায় রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি সরকার জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অ্যাম্বুলেন্স সেবাকে যুক্ত করেছে। তবে ঘোড়াঘাট উপজেলা থেকে টোল ফ্রি এই জরুরি সেবার মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্সকে কল করলে, এ সেবার আওতায় থাকা অ্যাম্বুলেন্স আসতে এক ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে। কোনো কোনো সময় অপেক্ষা করতে হয় ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত।
কারণ ঘোড়াঘাট উপজেলার কোনো প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এই সেবার আওতায় নেই। ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সেসব উপজেলা থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ভুক্তভোগী এমনই এক যুবক ঘোড়াঘাট পৌর এলাকার নয়াপাড়া গ্রামের জোবায়ের হোসেন। তিনি বলেন, গত বুধবার আমার এক নিকটাত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি ৯৯৯-এ কল করি। তারা আমাকে জানায়, ঘোড়াঘাট উপজেলায় প্রাইভেট কোনো অ্যাম্বুলেন্স এই সেবার আওতাভুক্ত নেই। পরে তারা আমাকে দিনাজপুর সদর উপজেলার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে চায়। পরে ৯৯৯ এর ওই কর্মকর্তাকে আমি সদর উপজেলার দূরত্ব সম্পর্কে জানালে তিনি আমাকে পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেড় ঘণ্টার মতো সময় নেয়। আবার ভাড়াও দিতে হয় দ্বিগুণের অধিক।
ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আনোয়ার বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে এখানে যোগদান করেছি। সচল থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সের যান্ত্রিক কিছু ত্রুটি মেরামত এবং নতুন আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স যুক্ত করার জন্য সিভিল সার্জনকে আমি জানিয়েছি। অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি এসব অ্যাম্বুলেন্স রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দের বিষয় রয়েছে। এছাড়া আমাদের চালক সংকট। আগে দুজন চালক ছিলেন। তার মধ্যে একজন অন্যত্র বদলি হয়েছে। অন্যজন মামলা সংক্রান্ত সমস্যায় বরখাস্ত। বর্তমানে হাসপাতালের মালি সচল ওই একটি অ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসেবে কাজ করছেন।
মাহাবুর রহমান/এফএ/এএসএম