মৃতপ্রায় রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদী, পুরোপুরি বিলীন ১৫-২০টি
পানির অভাবে নাব্যতা হারিয়ে রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদী এখন মৃতপ্রায়। এছাড়া পুরোপুরি বিলীন হয়েছে ১৫-২০টি নদীর অস্তিত্ব। নদীগুলো উদ্ধারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে মরুকরণের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্ধশতাব্দী আগেও এ অঞ্চলের দুই শতাধিক নদ-নদীতে ছিল উত্তাল পানির প্রবাহ ও প্রাণের স্পন্দন। এখন সেই ভরা যৌবনে পড়েছে ভাটা। হারিয়ে যেতে বসেছে নদীর অস্তিত্ব। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
নদী রক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদের ‘রংপুর অঞ্চলের নদ-নদী’ বই থেকে জানা যায়, রংপুর বিভাগের আট জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা দুই শতাধিক। যার শতাধিক নদীই আজ মৃতপ্রায়। বাকি যে কয়েকটি নদী আছে তার গতি ঠিক রাখতেও নেই কোনো পরিচর্যা।
উত্তরের প্রাচীনতম জনপদ রংপুর অঞ্চলের গাইবান্ধায় রয়েছে আলাই, ইছামতি, করতোয়া, কাটাখালি, কালপানি, গাংনাই/খিয়ারী, ঘাঘট, তিস্তা, নলেয়া, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মৎস, মরা, মরুয়াদহ, মাইলা মানাস, মাশানকুড়া, বাঙালি, লেঙগা, শাখা তিস্তা, হলহলি।
নীলফামারীতে আছে আউলিয়াখান, করতোয়া, কলমদার, কুমলাল, খড়খড়িয়া, খলিসাডিঙি, চারা, চারালকাঠা, চিকলি, চেকাডারা, তিস্তা, দেওনাই, ধাইজান, ধুম, নাউতারা, নেংটিছেঁড়া, বামনডাঙা, বুড়িখোড়া, বুড়িতিস্তা, বুল্লাই, যমুনেশ্বরী, শালকি, স্বরমঙলা।
কুড়িগ্রামে অন্তাই, কালজানি, কালো, কুরসা, কোটেশ্বর, খলিশাকুড়ি/অর্জুনেরডারা, গঙ্গাধর, গদাধর, গিরাই, গোদ্ধার/বোয়ালমারী, ঘড়িয়ালডাঙা, ঘাগুয়া, চন্ডিমারী, চাকিরপশা, চান্দাখোল, জালশিরা, জিঞ্জিরাম, তিস্তা, তোর্সা, দুধকুমার, দেউল, ধরণী, ধরলা, নওজল, নাগদহ, নীলকুমার, নাগেশ্বরী, পয়রাডাঙা, পাঁচগাছিরছরা, ফুলকুমার, ফুলসাগর, বামনী, বারোমাসি, বুড়িতিস্তা, বুড়া ধরলা, বোয়ালমারী, ব্রহ্মপুত্র, মহিশকুড়ি, রতনাই, শিয়ালদহ, সঙ্কোশ, সোনাভরি, হলহলিয়া, হাওরার বিল, হাড়িয়ার ডারা।
লালমনিরহাটে রয়েছে গিদারী, চতরা, ছড়াবিল, তিস্তা, ত্রিমোহনী, ধরলা, ভেটেশ্বর, মরাসতী, মালদাহা, রতনাই, সতী, সাকোয়া, সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, স্বর্ণামতী।
রংপুরে আখিরা, আলাইকুড়ি, ইছামতি, করতোয়া, কাঠগড়ি, খাঁড়ুভাঁজ, খোকসাঘাঘট, ঘাঘট, ঘিরনই, টেপরীর বিল, তিস্তা, ধুম, নলশীসা, বুড়াইল, ভেলুয়া, মরা, মানাস, যমুনেশ্বরী, সোনামতি, শাখা চিকলি, চিকলি, বুল্লাই, নলেয়া, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, বুড়াইল, নেংটি ছেড়া, মাশানকুড়া।
ঠাকুরগাঁওয়ে অহনা/নহনা, কুলিক, খোড়া, চারাবান, ছোট ঢেপা, ছোট সেনুয়া, টাঙন, তীরনই, নাগর, পাথরাজ, ভক্তি, ভুল্লি, লাচ্ছি, লোনা, শুক, সেনুয়া, ধরধরা।
দিনাজপুরে আছে আত্রাই, ইছামতি, করতোয়া, কালা, কাঁকড়া, কাঞ্চন, গর্ভেশ্বরী, ঘাকশিয়া, ঘিরনই, চিরনাই, চিরি, ছোটযমুনা, ঢেপা, তিলাই, তুলসিডাঙা, তেতুলিয়া, নর্ত, নলশীসা, নাল, পাথারঘাটা, পুনর্ভবা, বিজরা, বেলান, ভাবকি, ভেলামতি, মহিলা, মাইলা, রণগাঁও, শাশুয়া।
পঞ্চগড়ে আছে আলাইকুমারী, করতোয়া, কাঠগিরি, কালিদহ, কুরুণ, কুরুম, খড়খড়িয়া, গোবরা, ঘোড়ামারা, চাওয়াই, চিলকা, ছাতনাই, ঝিনাইকুড়ি, টাঙন, ডাহুক, ডারা, ডারি, তালমা, তীরনই, তিস্তাভাঙা, নাগর, পাইকানি, পাঙা, মরাতিস্তা, পাম, বহু, বাগমারা, বহিতা, বুড়িতিস্তা, বেরং, বোরকা, ভেরসা, মহানন্দা, যমুনা, রণচন্ডী, রসেয়া, রাঙাপানি, শালমারা, সাও, সিংগিয়া, সুই, হাতুড়ি ও হুয়াড়ি।
তবে নদী ‘থাকাটা’ এখন অনেকটাই ‘কাগজে’ চলে গেছে। এসব নদীর অধিকাংশেরই এখন নাব্যতা নেই। শুষ্ক মৌসুমে কোনো কোনো নদীতে হাঁটুজলও শুকিয়ে গেছে। একসময় এসব নদীর বুকে পাল তোলা নৌকায় পারাপার হলেও এখন পায়ে হেঁটে চলছে মানুষ।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নে তিস্তার চরে কথা হয় সোলেমান ও আজিজুলের সঙ্গে।
তারা জানান, একসময় বছরজুড়ে এ নদীতে মাছ ধরেই চলতো তাদের সংসার। এখন শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় থাকে হাঁটুপানি। হ্রাস পেয়েছে নাব্যতা। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা চরে কৃষকরা বাদাম, ভুট্টা, আলু, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করেন। অথচ বর্ষাকালে নদীর ভাঙনে প্রতিবছর বিলীন হয়ে যায় কূলবর্তী মানুষের ঘরবাড়ি।
সামান্য বর্ষার ছোবলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করতোয়া নদীও এখন পানিশূন্যতায় ধুঁকে মরছে। কোথাও নেই আগের সেই প্রবাহ। নেই ডিঙি নৌকা। ক্ষীণ এ নদীর প্রবাহ গাইবান্ধা ও বগুড়ায় প্রবেশ করে কিছুটা গতি পাওয়ার চেষ্টা করলেও তা এখন শুধুই ইতিহাস।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছের ওপর দিয়ে একসময় প্রবাহিত আলাইকুড়ি নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে।
কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে রংপুর নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদীও। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীটির বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাবে এই নদী। নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন শত শত মৎস্যজীবী। যার বুকজুড়ে লোকজন জবরদখল করে আবাদ করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, একসময় এ নদীটির ওপর দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলত। দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসত ব্যবসা করার জন্য। নদীপথে বিভিন্ন প্রকার পণ্য সরবরাহ করত লোকজন। সেই নদীর শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ এখন শূন্যের কোঠায়। নদীটি খনন করা হলে মৎস্য চাষসহ আবাদি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, নদীর সিকস্তি ও পয়স্তি আইন অনুসারে ঘাঘট নদীর বুকে জেগে ওঠা জমিগুলো খাস জমির অন্তর্ভুক্ত। যা স্থানীয় লোকজন জবরদখল করে আবাদ করছেন। একই অবস্থা মানাস নদীরও।
নদী গবেষকরা বলছেন, ভারত একতরফাভাবে পানিপ্রবাহ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় একসময়ের জনগুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর গুরুত্ব এখন নেই। একই কারণে রংপুর অঞ্চলের এমন প্রায় শতাধিক নদীতে পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এ ব্যাপারে রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের ভক্তি নগী, কুড়িগ্রামের মাষানকুড়া, হারাগাছের আলাইকুড়িসহ এ অঞ্চলের অন্তত ১৫-২০টি নদী পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় শতাধিক নদী।
তিনি বলেন, এসব নদী পুনরুদ্ধার করতে হলে সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখল তুলে দিতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নদীর তলদেশ খনন, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উৎসমুখ উন্মোচন করে পরিচর্যা ও দুষণমুক্ত করতে হবে। তা নাহলে ধীরে ধীরে পানির স্তর নিচে নেমে এ অঞ্চল মরুকরণ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জিতু কবীর/এমএইচআর/জিকেএস