পদ্মায় বালুচর, কুমারের বুকে চলছে ধানচাষ
অডিও শুনুন
ফরিদপুরে ৭টি নদী। নদীগুলোর অবস্থা বেহাল। তারা মোটেও ভালো নেই। মূল কারণ দখল আর দূষণ। শুধু দখল-দূষণই নয়। পাশাপাশি ভরাট হয়ে ফরিদপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো।
ফরিদপুর জেলার চারপাশ জুড়ে রয়েছে প্রমত্তা পদ্মা নদী। এছাড়াও রয়েছে আড়িয়াল খাঁ, আত্রাই, বিল বিলরুট, মধুমতি, চন্দনা, বারাশিয়া, ভুবনেশ্বর ও কুমার নদ-নদী। জেলার নয়টি উপজেলাকে কম বেশি আঁকড়ে ধরেছে নদ-নদীগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলা গঠিত হয় ১৮১৫ সালে। ফরিদপুর পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ফরিদপুর সদর উপজেলা সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ছোট উপজেলা আলফাডাঙ্গা। ফরিদপুরে প্রধান নদ-নদীর মধ্যে পদ্মা, পুরাতন কুমার, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই, ঢোল সমুদ্র, রামকেলী, ঘোড়াদার এবং শকুনের বিল উল্লেখযোগ্য। জেলার চারপাশ জুড়ে রয়েছে প্রমওা পদ্মা। কিন্তু নদীগুলো ভুগছে নাব্য সংকটে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রমত্তা পদ্মায় জেগেছে ডুবোচর। ফলে পানির প্রবাহ না থাকায় পদ্মার প্রধান শাখা নদী কুমার, মধুমতি, ভুবনেশ্বর, চন্দনা, বারাশিয়াও হারিয়েছে নাব্যতা। ফরিদপুর জেলা সদরের ডিক্রীরচর ইউনিয়নের মদনখালীর পদ্মা-কুমার নদীর সংযোগস্থল তথা কুমার নদীতে পানি প্রবেশের উৎসটি পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে কুমার নদীতে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মার পানি কমে যাওয়ায় কুমার শুকিয়ে মরা খাল হয়ে গেছে।
অপরদিকে নদী ভরাট করে চলছে দখলের পাল্লা। কুমার নদীর দুই পাড় দখল করে যে যার মতো পাকা ঘরবাড়ি তুলেছে। নদীর মধ্যে বাঁশ দিয়ে মাঁচা পেতে টোঙ ঘর তৈরি করায় বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ প্রচণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। পাল্লা দিয়ে চলছে নদীতে ময়লা আবর্জনা ও বর্জ নিক্ষেপ।
এসব কারণে কুমার নদীর প্রায় ৬৪ কিলোমিটার খাল খননে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ কোনো কাজেই আসছে না। কুমার নদীতে ৬০টি ঘাটলা নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু পাতিল ধোয়ার পানিটুকুও নেই।
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মাই এখন ধু ধু বালুচর। সদরপুর উপজেলার চরমানাইর, চর হরিরামপুর, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম ও সদরপুরের ভাটি অঞ্চল, চরভদ্রাসনের পিয়াজখালী বাজার এবং হাজিগঞ্জের মোহনা শয়তানখালী থেকে ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার পদ্মার বুক জুড়ে জেগে উঠছে প্রায় ২০০টি ডুবোচর। পদ্মায় ডুবোচরে আটকা পড়েছে ডজন খানেক জাহাজ, বাল্কহেড এবং কাঁচামালবাহী কার্গো। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পণ্য পরিবহনকারী নৌযান মালিকরা এবং কাঁচামাল শিল্পের ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ থেকে সিমেন্টবোঝাই করে আনা দুই সারেং রহমান এবং করিম ফকির জাগো নিউজকে জানান, ব্যবসার সমস্ত লোকসানের প্রধান কারণই পদ্মায় পানি নেই। শুধু ডুবোচর। এর প্রভাব পড়ছে ফরিদপুরের ৭টি নদীতে। ফলে ফরিদপুর ছোট বড় ৭টি নদী এখন পানিশূন্য হয়ে গেছে।
পদ্মার প্রধান শাখা নদী কুমার, সেখানে এখন ধানক্ষেত। আড়িয়াল খাঁ নদীর বুকজুড়ে বালুর মাঠ। পাশাপাশি কুমার নদী, বারাশিয়া, মধুমতি, চন্দনা, ভুবনেশ্বর দখল করেছে প্রভাবশালী দখলদাররা। চলছে দোকান ঘর ও বাসাবাড়ি নির্মাণের কাজ। থামানোর কেউ নেই। ফলে আকারে ছোট হয়ে আসছে নদী।
আবার আবর্জনা ও বর্জে নদী ভরাট হওয়ায় পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা।
ফরিদপুর সদরের হাজী শরীয়তুল্লা বাজার বেইলি ব্রিজের পূর্বপাড় মিষ্টি ব্যবসায়ীদের দখলে। সাপ্তাহে দুইদিন হাটের কাঁচাবাজারের ময়লা ফেলা হয় নদীতে। পাশাপাশি শরীয়তুল্লা বাজারের প্রতিদিনের ময়লা আবর্জনা ফেলায় পুরো নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। সঙ্গে ময়লা আবর্জনায় হারিয়ে গেছে ৬০ বছর আগের বাজার ঘাটলাটিও।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি নঈমুদ্দিন মন্ডল, গদাধর মালোসহ একাধিক ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, শুকনো মৌসুমে নাব্য সংকটে পড়েছে ফরিদপুরের শতাধিক নদ, নদী, খালসহ অন্যান্য জলাশয়। এতে পানি সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। পানির অভাবে পণ্য আনা নেওয়া করা যাচ্ছে না একমাত্র নদী বন্দর দিয়েও।
তারা জানান, একসময় ভুবনেশ্বর নদী দিয়ে চলাচল করতো বড়বড় জাহাজ, স্টিমার ও কার্গো। এখন সে নদীর বুকে চাষ হচ্ছে ফসল। অনেকে আবার দখল করেও নিয়েছেন বড় অংশ।
ফরিদপুরের বোয়ালমারীর প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাবু জীবন পাল ও নিরাপদ কর্মকার জাগো নিউজকে বলেন, একসময় নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহার হওয়ায় মাঠে তিন ফসলেরই বাম্পার ফলন হতো। প্রতি বছর জোয়ারের পানিতে নিচু এলাকা এবং ফসলের মাঠে ভরে যেত। পদ্মার পানিতে নতুন পলি আসায় ফসলও হতো বেশ ভালো। নতুন পানির সঙ্গে নানান প্রজাতির দেশি মাছ এসে ভরে যেত গ্রামগঞ্জের পুকুর বিল ও হাঁওড়। নতুন পানিতে ভেসে যাওয়া বিলে শত শত জেলেরা নানান প্রজাতির দেশি মাছ ধরে বিক্রি করতেন হাটে বাজারে। কিন্তু ফারাক্কার প্রভাবে উজান থেকে আশা পলি পড়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে জেগে উঠছে শত শত ডুবোচর। পানি না থাকায় আমন এবং ইরি মৌসুমে ফসলের মাঠও পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
ফরিদপুরের নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের বিয়াল্লিশ আটত্রিশ দাগের বাসিন্দা ইদ্রিস শেখ, কালাম ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ৪০ বছর ধরে পদ্মানদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু এখন খুব একটা মাছ পাওয়া যায় না। এক সময় পদ্মার যৌবন ছিল। কুমার নদী ভরা ছিল পানিতে। সারা বছরই স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো। এখন নদীতে পানি নেই। তাই পেশা পরিবর্তন করে জীবন চালাচ্ছে জেলেরা।
বালি পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আনয়নকারী মেসার্স মো. মুজিবুর রহমানের সত্তাধিকারী মো. মুজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পানি সংকটে পণ্য আনা নেওয়া কমে গেছে ফরিদপুরের একমাত্র নদীবন্দর দিয়ে। এ বন্দর দিয়ে নিয়মিত অর্ধশতাধিক রকমের পণ্য আনা নেওয়া করা হয়। পানি সংকটের কারণে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে কার্গো নোঙর করে ছোট নৌযান দিয়ে পণ্য খালাস করায় বাড়ছে ব্যয়।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা জাগো নিউজকে বলেন, দখল আর দূষণের পাশাপাশি ভরাট হয়ে ফরিদপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো। ফরিদপুরবাসীর জলাধারের অভাব পূরণ করতে কুমার নদের বিকল্প নেই। নদীগুলো বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি আমারদের সকলকে সচেতন হওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, উল্লেখিত সব বিষয় আমরা জেনেছি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ফরিদপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা জাগো নিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ করবো।
এফএ/জিকেএস