‘স্বামীরা তো তিন হাত দিয়ে কাজ করে না, আমাদের মজুরি কম কেন?’

মাহাবুর রহমান মাহাবুর রহমান , হিলি (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১২:২৭ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২২
মাঠে কাজ করছেন ষাটোর্ধ্ব সন্ধ্যা তির্কি। ছবি: জাগো নিউজ

সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে গরুর গোয়াল পরিষ্কার করে স্বামী, সন্তানদের জন্য রান্না করি। তাদের খাবার খাইয়ে নিজের ও স্বামীর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠের জমিতে ধানের চারা রোপণ, নিড়ানিসহ পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু দিন শেষে আমার স্বামী মজুরি পায় ৫০০ টাকা আর আমরা নারীরা পাই সাড়ে তিনশ টাকা। কাজের বেলায় সমান সমান হলেও মজুরির বেলায় অনেক কম।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার রামচন্দ্রপুর গ্রামের একটি সরিষা ক্ষেতে কাজ করতে করতে ওই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব সন্ধ্যা তির্কি আক্ষেপ করে কথাগুলো বললেন।

তিনি বলেন, আমরা কাজ তো ঠিকই করি। স্বামীরা কি তিন হাত দিয়ে কাজ করে? তাহলে আমাদের মজুরি কম কেন? নারী বলে আমাদের মজুরিতে মূল্যায়ন কম করা হয়।

সেখানেই কথা হয় একই গ্রামের পূর্ণিমা টপ্যর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা সকাল ৮টার দিকে স্বামীসহ একই সময় কাজে যাই। কাজ করি বেলা ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। উনাদের নিয়ে আসে ৫০০ টাকা। আমরা টাকা পাই সাড়ে তিনশ। আমাদের কেন কম দেবে?

তিনি বলেন, তেল নিতে গেলে ২০০ টাকা কেজি লাগে। লবন ৩৫ টাকা, চাল ৫০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের কীভাবে চলবে? বাচ্চাদের লেখাপড়া করাবো না সংসার চালাবো?

কথা হয় কুমারী বুলবুলি খালকোর সঙ্গে। তিনিও শোনালেন একই আক্ষেপের কথা। তার ভাষ্য, আমরা সকাল ৬টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। রান্নাবান্নাসহ সংসারের অন্য কাজ শেষ করে স্বামীকে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজে চাই। বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে স্বামীরা নিয়ে আসে ৫০০ টাকা আর আমাদের বেলায় সাড়ে তিনশ টাকা। কেন আমাদের কম দেবে, ছেলেরা কেন বেশি পায়?

jagonews24

তিনি বলেন, এই টাকায় ছেলেমেয়ের পোশাক কিনবো নাকি চাল কিনবো? আমাদের কথা হলো, আমরা শ্রমের একই মূল্য চাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট ও হাকিমপুর এই চার উপজেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। তাদের মধ্যে সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, মাহালি, মুচি সম্প্রদায় অন্যতম।

জানতে চাইলে দাউদপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিক পাওয়া যায়। তারা সমান কাজ করেন। কিন্তু তাদের আগে থেকেই মজুরি কম দেওয়ার কারণে আমরাও কম দিয়ে থাকি। এটা সমান হলে ভালো হয়।

তিনি বলেন, নারীদের তুলনায় পুরুষরা একটু কাজে বেশি পারদর্শী। তাই মনে হয়ে এমন বৈষম্য করা হয়। আমি চাই উভয় সমান মজুরি পাক।

বিরামপুর উপজেলা আদিবাসী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস মুর্মু বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিটি কাজে অংশ গ্রহণ করছেন। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের তেমন বেতন বৈষম্য না থাকলেও কৃষি কাজে শ্রমের বৈষম্য রয়েছে। এটা সমান হওয়া দরকার।

বিরামপুর উপজেলার কাটলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস আলী বলেন, বিরামপুর উপজেলায় প্রায় ১২ হাজারের বেশি নৃগোষ্ঠীর নারী শ্রমিক কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের যে মজুরি বৈষম্য এটি সমাজের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। ফলে নারী দিবসে আমার দাবি, দ্রুত তাদের মজুরি সমান করা হোক।

জানতে চাইলে বিরামপুর উপজেলা আদিবাসী সমিতির সভাপতি ও খানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন পাহান বলেন, আমি যতদূর জানি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মধ্যে আমাদের নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা বেশি। অনেক আগে থেকেই পুরুষ ও নারীদের শ্রমের বৈষম্য দেখা যায়।

তিনি বলেন, এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজসেবকদের এগিয়ে এসে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে এর সমাধান করা প্রয়োজন। তাহলে এটা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব।

জানতে চাইলে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার বলেন, সমাজের প্রতিটি জিনিসের যেমন একটা নিদিষ্ট কাঠামো রয়েছে, মাঠে কর্মরত নারী ও পুরুষের মজুরির বিষয়েও তেমন একটা নির্দিষ্ট কাঠামো থাকা দরকার।

মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি শিবলী সাদিক বলেন, বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। শ্রমের মজুরির বৈষম্যের বিষয়টি কোনোভাবেই মানা যায় না। বিষয়টি নিয়ে আগামীতে যদি সুযোগ হয় তাহলে আমি জাতীয় সংসদে আলোচনা করবো।

এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।