‘পরিচয় জেনে সিনহাকে স্যালুট দিয়েও গুলিতে সহযোগিতা করলেন কেন?’
কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। কেননা আমার মনে খটকা লেগেছিল, সিনহার পরিচয় জানার পর স্যালুট দিয়েছিলেন চেকপোস্টে থাকা সদস্যরা। এর একটু পর তারাই কেন আবার গুলি করতে (পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে) সহযোগিতা করলেন?’
সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল রায় ঘোষণার আগে এ পর্যবেক্ষণ দেন। বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে ওই হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করে প্রদীপ কুমার ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাদের সহযোগিতা করার অপরাধে ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যসহ সাতজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী জবানবন্দি দিয়েছেন যে—সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন ওসি প্রদীপ। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে গুলি করেন তিনি। ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে সিনহার বুকের বাঁ পাশে লাথি মারেন। এতে সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান।
বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতের জবানবন্দির কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, লিয়াকত আগে থেকেই নন্দুলালকে বলেন, (সিনহাকে বহনকারী) সিলভার কালারের গাড়ি থামাতে হবে। (চেকপোস্টে) সিনহার দুই হাত উঁচু ছিল। সেসময় লিয়াকত গুলি করেন। ঘটনাস্থলে প্রদীপ আসার পর সিনহার উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক কষ্টের পরে তোরে পাইছি’। এই বলেই বুকে লাথি মারেন। নন্দদুলাল বলেছেন, ওসি প্রদীপের ভয়ে জব্দ তালিকা তৈরি করেছেন। তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই তৈরি করেছেন জব্দ তালিকা।
হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে লিয়াকত ও নন্দদুলাল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, এটা প্রমাণিত বলেও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন আদালত।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা।
হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত। কক্সবাজারের র্যাব-১৫ মামলাটির তদন্তভার পায়।
ওই বছরের ৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসেন।
এ মামলায় চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
দীর্ঘশুনানি, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে গত ১২ জানুয়ারি রায়ের জন্য ৩১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন বিচারক।
টিটি/এইচএ/এএসএম