নওগাঁয় কলাচাষে ঝুঁকছেন চাষিরা, প্রতি হাটে অর্ধকোটি টাকার বেচাকেনা
উৎপাদন খরচ ও পরিশ্রম কম এবং লাভজনক হওয়ায় নওগাঁয় বেড়েছে কলাচাষ। কলাচাষকে কেন্দ্র করে জেলার মান্দা উপজেলার সতিহাটে গড়ে উঠেছে কলা বেচাকেনার হাট। এ হাটে সপ্তাহে প্রায় ৫০ লাখ টাকার কলা বেচাকেনা হয়। সতিহাটের কলা চলে যায় ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় ১১৪০ হেক্টর জমিতে কলাচাষ হয়েছে। এরমধ্যে মান্দা উপজেলায় ২১৫ হেক্টর, মহাদেবপুর উপজেলায় ২২০ হেক্টর, ধামইরহার উপজেলায় ২৯০ হেক্টর, বদলগাছী উপজেলায় ২২৫ হেক্টর এবং সদর উপজেলায় ৬০ হেক্টর। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০৫৯ হেক্টর এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০৩৩ হেক্টর জমিতে কলাচাষ হয়েছিল।
সপ্তাহে মঙ্গলবার ও শুক্রবার—এ দুদিন হাট বসে সতিহাটে। নওগাঁ সদর, মান্দা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী রাজশাহী জেলার বাগমারা ও মোহনপুর উপজেলার কিছু এলাকা থেকেও চাষিরা কলা নিয়ে আসেন এই হাটে। গত প্রায় দুই যুগ ধরে এ হাটে কলা বেচাকেনা হচ্ছে। এ হাট থেকে কলা চলে যায় ঢাকার কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও এবং ব্রাহ্মবাড়িয়াসহ কয়েকটি জেলায়।
প্রতি হাটে ১৫ ট্রাক কলা যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। এছাড়া স্থানীয় খুচরা ব্যবাসয়ীরা প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো কলা বেচাকেনা করেন। রমজান মাসে একই পরিমাণ কলার দাম বেড়ে হয় প্রায় দেড়গুণ।
কলাচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাভজনক হওয়ায় তাদের মধ্যে কলাচাষে আগ্রহ বেড়েছে। তবে কলাচাষে কিছু সমস্যা আছে বলেও জানিয়েছেন চাষিরা। তাদের মতে, বাজারে মানিক কলার দাম বেশি হলেও বাগানে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। অন্যদিকে চিনি চম্পাকলা গাছে রোগের প্রার্দুভাব কম হয়। এজন্য চিনি চম্পাকলা চাষ করছেন তারা।
দুই বিঘা জমিতে গত ১০ বছর থেকে কলাচাষ করে আসছেন মান্দার গনেশপুর গ্রামের চাষি আতিকুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় ওই জমিতে আলু, পটলসহ অন্যান্য সবজি আবাদ করতাম। সবজির আবাদ করার সময় ক্ষেতে সবসময়ই কাজ করতে হতো এবং খরচও বেশি পড়তো। সবজিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাম পাওয়া যেত। এরপর সবজির আবাদ ছেড়ে ওই জমিতে কলার চাষ শুরু করলাম। কলাচাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। লাভও বেশি।’
কলাচাষের পদ্ধতির বিষয়ে তিনি বলেন, জমি প্রস্তুত করে বিঘাপ্রতি ২৮০-৩০০টি চারা লাগানো হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জমিতে চারা লাগানোর দু-একদিন পর সেচ দিতে হয়। এর ১৫-২০ দিন পর মুঁচি (চারা) গজানো শুরু হলে ইউরিয়া সার দেওয়া হয়। ৩০-৩৫ দিন পর ডিএপি (ড্যাপ), পটাশ, জিংক ও বোরন সার দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে কীটনাশকও দেওয়া হয়।
গাছে কলা আসতে ৭ থেকে ৮ মাস সময় লাগে বলে জানান চাষি আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, কলা পরিপক্ক হতে আরও দুইমাসের মতো সময় লাগে। প্রথম বছর যেহেতু চারা থেকে গাছ হয় এজন্য কলা আসা ও পরিপক্ক হতে সময় লাগে। দ্বিতীয় বছর আটমাসের মধ্যে কলা বাজারজাত করা হয়। প্রতি বিঘা থেকে প্রতি বছর ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার মতো দাম পাওয়া যায়। আর প্রতি বিঘাতে খরচ পড়ে ১২ হাজার ১৫ হাজার টাকা।
একবার চারা রোপণ করলে ৪-৫ বছর পর্যন্ত জমিতে থাকে। কলা বিক্রি করে বছর শেষে একবারে মোটা টাকা পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কলা কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক সময় নিজেরাই কলা হাটে নিয়ে যান।
১৫ কাঠা জমিতে কলাচাষ করে গত রমজানে ৫০ হাজার টাকার কলা বিক্রি করেছেন একই গ্রামের চাষি আফসার আলী। এবার বিক্রি করেছেন ৪০ হাজার টাকার কলা। বর্তমানে তিনি দেড়বিঘা জমিতে চিনি চম্পাকলা চাষ করেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি সতিহাটে কলা বিক্রি করতে এসেছিলেন উপজেলার মেরুল্লা গ্রামের চাষি মাসুদ রানা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ১১ বছর ধরে ১০ বিঘা জমিতে কলাচাষ করছি। প্রথম পাঁচ বছর মানিক কলা এবং তারপর থেকে চিনি চম্পাকলা চাষ করছি। প্রতি হাটেই কলা নিয়ে আসা হয়। এখন একটু দাম কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে রমজান মৌসুমে বেশি দাম পাওয়া যায়।’
২০০৬ সাল থেকে কলা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মহাদেবপুর উপজেলার বিনোদপুর গ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ী সামছুল হক।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ হাটে আমার মতো ২০ জন ব্যবসায়ী আছেন। প্রতি হাটে প্রায় ১৫ ট্রাক কলা ঢাকার কারওয়ান ও তেজগাঁও এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি জেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রতি ট্রাকে প্রায় তিন লাখ টাকার কলা থাকে। সে হিসাবে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার কলা যায়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে আশপাশের কিছু খুচরা ব্যবসায়ী প্রায় পাঁচ লাখ টাকার কলা বেচাকেনা করেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি হাটে প্রায় ৯০ হাজার থেকে লাখ টাকার মতো কলা ঢাকায় পাঠাই। এর সঙ্গে কিছু ভাড়া ও আনুষঙ্গিক টাকা যোগ হয়। সবকিছু বাদ দিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মতো লাভ থাকে।’
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল ওয়াদুদ বলেন, উৎপাদন খরচ ও পরিশ্রম কম এবং লাভজনক হওয়ায় নওগাঁয় কলাচাষ বেড়েছে। একবার কলার চারা রোপণ করলে তা কয়েক বছর পর্যন্ত জমিতে রাখা যায়। কৃষকরা যোগাযোগ করলে কৃষি অফিস থেকে তাদের সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হবে।
আব্বাস আলী/এসআর/জিকেএস