ফেলানীর বাবার দাবি অমিয় ঘোষের ফাঁসি
কুড়িগ্রামে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার। এই দিনে ২০১১ সালে ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোরী ফেলানী। এ উপলক্ষে পারিবারিকভাবে আয়োজন করা হয় মিলাদ মাহফিল ও কাঙ্গালি ভোজের।
এছাড়া ‘আলোর আশা পাঠশালা’ ৭ জানুয়ারি সীমান্ত হত্যা বন্ধ দিবস ঘোষণার দাবিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, মানববন্ধন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।
প্রতিবেশি বিশ্বজিত রায় জানান, হাতে মেহেদী রাঙাতে যে কিশোরী মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন তার মা, সেই ফেলানী বিএসএফের গুলিতে চির বিদায় নিয়ে শুয়ে আছে পাঁচ বছর ধরে। কবরের পাশে বসে মা জাহানারা বেগম আর বাবা নুর ইসলাম নুরু হাহাকার ছাড়া করার আর কিছুই যেন করার নেই। রামখানা ইউনিয়ন বাড়ির একটি ঘরে কোনোরকমে মাথা গুঁজেছে ফেলানীর বাবা-মা ও ভাই-বোনরা। ওই ঘরটির সামনের অংশে একটি ছোট মুদি দোকান দিয়েছেন মা জাহানারা।
নাখারগঞ্জ বাজারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বিজিবির দেয়া অপর দোকানটি চালাচ্ছেন বাবা নুর ইসলাম। কিন্তু পাঁচ সন্তানদের পড়াশুনা আর সংসারের অতিরিক্ত খরচের চাপে ধীরে ধীরে মালামাল কমে গেছে। যা লাভ হয় তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপাড়া ও সংসার খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফেলানীর হত্যার ন্যায় বিচার না পেয়ে ফেলানীর পরিবার ও গ্রামবাসীরা হতাশা প্রকাশ করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাহারা খাতুন অনেক প্রতিশ্রুতির মধ্যে শুধুমাত্র ফেলানীর কবরটি পাকাকরণ ছাড়া আজ পর্যন্ত অন্যান্য প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। ভারতের উচ্চ আদালত মামলা গ্রহণ করায় আমি আশাবাদী ন্যায় বিচার পাবো। এ আশা নিয়ে বুক বেঁধে আছেন। তার একটাই প্রত্যাশা ফেলানীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের ফাঁসি। নুরু আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ভারত সরকার ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে তামাশা শুরু করেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জাগো নিউজকে জানান, বহুল আলোচিত ফেলানী হত্যা মামলায় ঘাতক অমিয় ঘোষকে দুইবার নির্দোষ রায় দিলেও গত বছর ১৪ জুলাই ফেলানীর বাবার পক্ষে ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ দেশটির সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। ওই বছর ২৬ আগস্ট এ মামলার শুনানি হয়ে পরবর্তী ৬ অক্টোবর পুনরায় তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত।
পরবর্তীতে ৬ অক্টোবর ভারতের দিল্লীর সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হবার কথা থাকলেও মামলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। তিনি আরও জানান, ভারতের সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ ভেঙে নতুন বেঞ্চ গঠিত হবার পর সেখানেই ফেলানী হত্যার মামলার শুনানি বা নিষ্পত্তি হবে। তাই এবার ফেলানীর পরিবার ন্যায় বিচার পাবেন বলে প্রত্যাশা তার।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর সোয়া ছয়টার দিকে দালালের মাধ্যমে মই বেয়ে কাটাতারের বেড়া পাড় হবার সময় ভারতীয় বিএসএফের গুলিবিদ্ধ হয়ে আধাঘণ্টা ধরে ছটফট করে নির্মমভাবে মৃত্যু হয় কিশোরী ফেলানীর। ভারত থেকে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় এ নৃশংসতার শিকার হয় ফেলানী। এরপর সকাল পৌনে সাতটার থেকে নিথর দেহ কাঁটাতারের উপর ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা। পরে বিএসএফ মরদেহ নামিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। এরপর বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে মৃত্যুর ৩০ ঘণ্টা পর (৮ জানুয়ারি) শনিবার মরদেহ ফেরত দেয় বিএসএফ।
বাংলাদেশে আর এক দফা ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ দাফন হয় ৭৩ ঘণ্টা পর। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কুড়িগ্রামে এসে ফেলানীর মা ও ভাই-বোনদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তায় সারাদিন লুকোচুরি খেলা শেষে বিকেলে ফেলানীর মা ও ভাই-বোনদের বাংলাদেশে ফেরত দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনাটি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচনার ঝড় তোলে। খোদ ভারতের গণমাধ্যমগুলোর সোচ্চার ভূমিকায় কোচবিহারের ১৮১ ব্যাটালিয়ন বিএসএফের বিশেষ আদালতে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে ভারত সরকার। ১৯ আগস্ট আদালতে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ও মামা আব্দুল হানিফ সাক্ষ্য দেন।
এ বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন কুড়িগ্রাম ৪৫ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ এবং কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন।
কিন্তু অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমীয় ঘোষকে ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বেকসুর খালাস দেন বিশেষ আদালত। এই রায় প্রত্যাখ্যান করে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে মানবাধিকার সংগঠন আসকের (আইন ও সালিশ কেন্দ্র) মাধ্যমে আবেদন করেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ।
এরই প্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বর বিএসএফ রিভিশন ট্রায়াল করার ঘোষণা দেন। ঘোষণার এক বছর পর ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পূর্ণ বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে বিশেষ আদালত। সাক্ষী ছাড়াই তিন দিন আদালত চলে। এবার শুধুমাত্র ফেলানীর বাবা পুনরায় সাক্ষ্য প্রদানের জন্য ১৬ অক্টোবর গিয়ে সাক্ষী শেষে দেশে ফেরেন ১৭ অক্টোবর। এরপর বিশেষ আদালত ২০ অক্টোবর আসামি অমীয় ঘোষ অসুস্থর কারণে গত বছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।
মুলতবি শেষে ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় ভারতের কোচবিহারে বিএসএফ সেক্টর সদর দফতরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতে ফেলানী হত্যার পূর্ণবিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এবার ৫ সদস্যের বিচারক মণ্ডলী উপস্থিত থাকলেও অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি ভারতের সরকারি আইনজীবী। এজন্য আদালত ২৯ জুন পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।
৩০ জুন মঙ্গলবার সকাল ১১টায় আবারও শুরু হয়েছে ফেলানী হত্যা মামলার পুনঃবিচারিক কার্যক্রম। টানা তিন দিন চলে বিচারিক কার্যক্রম। ২ জুলাই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ভারতের বিএসএফের বিশেষ আদালতের সোনারী ছাউনিতে বিএসএফ অধিকারিক সিপি ত্রিবেদীর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বিচারিক প্যানেল পুনরায় আসামি অমীয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেন।
নাজমুল হোসেন/এমজেড/আরআইপি