অসহায়ত্বের খবর পেলেই ছুটে যান মনসুর
এম মনসুর আলী (৪০) একজন পেশাদার সাংবাদিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা পাকশিমুল ইউনিয়নের বড়ইছড়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ওষুধ ব্যবসাও করেন। তবে এসব বাদেও ‘গরীবের বন্ধু’ হিসেবে তার আরেকটি পরিচয় আছে। কারণ, সুযোগ পেলেই তিনি অসহায়দের পাশে দাঁড়ান।
টাকার অভাবে বিয়ে না হওয়া মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করা, স্কুলড্রেস ও খাতাকলম কিনে দিয়ে ঝরে পড়া মেধাবী শিক্ষার্থীকে স্কুল বা কলেজে ভর্তি করা, তার যাবতীয় খরচ বহন করা, অসহায় দরিদ্র বহু রোগীকে নিজে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাসহ অসংখ্য মানবিক কাজের উদাহরণ দেওয়া যাবে তার। গত সোয়া চার বছরে মনসুর আলী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সহস্রাধিক অসহায় মানুষকে।
ওষুধ ব্যবসা থেকে আয়ের অধিকাংশই এসব কাজে ব্যয় করেন মনসুর আলী। ব্যক্তিগত অর্থের পাশাপাশি মনসুর আলীর মানবিক কাজে সাড়া দিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই অর্থ সাহায্য পাঠান। সেই বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন।
এমন সব স্বেচ্ছাসেবী মানবিক কাজের কারণে এলাকার মানুষ তাকে ‘গরিবের বন্ধু’ বলে ডাকেন। একই সঙ্গে এলাকাবাসীর দেওয়া উপাধিকেই তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে পরিণত করেন। এতে এলাকার তরুণ ও যুবকরাও জড়িত আছেন। এরই মধ্যে সংগঠনটি সরকারি নিবন্ধনও পেয়েছে।
জেলার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছিল। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। শয্যাশায়ী ছিলেন পাঁচ মাস। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্বজনরা। খবর পেয়ে মনসুর আলী যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলীর বাড়িতে। খোঁজ খবর নিয়ে এসে সাহায্যের আবেদন করে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন। পরে সরাইল সার্কেলের তৎকালীন এএসপি মনিরুজ্জামান ফকির বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। পাশে দাঁড়ান আরও কয়েকজন ব্যক্তি। পরে মন্তাজ আলীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায়ও নিয়ে যাওয়া হয়। এখন তিনি সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের কাকরিয়া গ্রামের বিধবা শরিফা বেগম (৩০)। ছোট ছোট চার সন্তান রেখে স্টিলবডি নৌকা তৈরির ডকইয়ার্ডে কাজ করার সময় আগুনে পুড়ে মারা যায় শরিফার স্বামী সবুজ মিয়া (৩৫)। মৃত্যুকালে সবুজ মিয়া স্ত্রী সন্তানদের জন্য সাতদিনের খাবারও রেখে যেতে পারেননি। ফলে সবুজ মিয়ার মৃত্যুর পর স্ত্রী শরিফা বেগম দিশেহারা হয়ে পড়েন। সন্তানের মুখের খাবার যোগাতে লজ্জা শরম জলাঞ্জলি দিয়ে শাড়ি কাপড় ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন।
'
বাকিতে বিক্রি করায় এক সময় পুঁজি হরাতে হয় তাকে। এরই মধ্যে দেশে বিস্তার শুরু করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। চরম অভাব দেখা দেয় সংসারে। দিনের পর দিন অবুঝ সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে ঘুমাতে হয় তাকে। অভাবের কারণে সন্তানসহ আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। এসব শুনে মনসুর আলী শরিফার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে তাকে একটি মুদির দোকান করে দেন। বর্তমানে সন্তানদের নিয়ে শরিফা স্বাভাবিক জীবযাপন করছেন।
এক দিন স্থানীয় এক বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলেন মনসুর আলী। হঠাৎ দেখলেন ১২-১৩ বছরের একটি ছেলে দুই হাত ও দুই পা ব্যবহার করে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিক্ষা করছে। এভাবে হাত-পায়ে ভর করে চলতে চলতে হাঁটুতে ঘা হয়ে যায় ছেলেটির। মনসুর আলী ছেলেটির কাছে গিয়ে বসলেন। জানলেন তার পরিচয়। এরপর ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই সাড়া পেয়েছিলেন তৎকালীন সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ইসরাতের কাছ থেকে। তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থেকেও দুদিনের মধ্যেই প্রতিবন্ধী হোসাইনকে হুইলচেয়ার দেন। চেয়ারে বসে হোসাইন স্বর্গের হাসি হেসেছিল।
করোনাকালে কয়েকশ’ মানুষকে ত্রাণ দিয়েছেন। এমনকি মধ্যবিত্ত লোক যারা অভাবের কথা বলতে পারেননি, লজ্জায় হাত পাততে পারেননি, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও মনসুর আলী নিজ উদ্যোগে রাতের আঁধারে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন। গত ২ বছর ধরে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার উপজেলার অরুয়াইল বাজারে ভিক্ষা করতে আসা অর্ধশতাধিক ভিক্ষুককে দুপুরের খাবার খাওয়ান তিনি।
এ ছাড়া মনসুর আলী ৭০ জন বিধবা ও অসহায় নারীকে সেলাই মেশিন, ৬০ জন প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার, ১০ জন জেলেকে নৌকা ও জাল, কয়েকজন বর্গাচাষিকে ধান মাড়াইয়ের মেশিন, পাঁচটি দরিদ্র মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সহায়তা, ঘর বাঁধার জন্য টিন, দরিদ্র ও এতিম ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ, বৃদ্ধদের শ্রবণযন্ত্র, তিনজন গরিব রোগীর সিজারিয়ান অপারেশনের ব্যয়ভার বহনসহ অন্তত ২০ জন রোগীর উন্নত চিকিৎসা করিয়েছেন। বর্তমানে বেশ কয়েকজন গরিব রোগীকে নিয়মিত ওষুধও কিনে দিচ্ছেন মনসুর আলী।
এ ব্যাপারে সরাইল সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো.আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিক এম মনসুর আলীর মানবিক কাজগুলো দেখে মুগ্ধ হই। তাকে সহযোগিতা করতে পারি না। তবে অনেককে সহযোগিতা করতে বলি। একদিন সারা দেশে মানবসেবার উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবেন তিনি।
পাকশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, মনসুর আলী অসহায় মানুষের জন্য যা করে তা প্রশংসনীয়। অরুয়াইল-পাকশিমুল ইউনিয়নের অনেক অসহায় বিধবা নারীকে সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। তিনি এই মানবিক কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বহুকাল বেঁচে থাকবেন।
এম মনসুর আলী জাগো নিউজকে বলেন, মানুষের উপকার করে আত্মতৃপ্তি পাই। কারও কোনো উপকার করতে পারলে নিজের কাছেও ভালো লাগে। এভাবেই সারাজীবন অসহায় মানুষের সেবা করতে চাই।
আবুল হাসনাত মো. রাফি/এসজে/জিকেএস