বিলাসবহুল অভিযান-১০ লঞ্চে ছিল পদে পদে অনিয়ম

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০৬:২৮ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১
আগুনে লঞ্চে বেঁধে রাখা বয়াও পুড়ে যায়

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার অভিযান-১০ লঞ্চটির যেসব নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, সেগুলো ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানান অনিয়মের তথ্য।

রোববার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে ঝালকাঠির লঞ্চ টার্মিনালে আগুনে পুড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চটি ঘুরে দেখা গেছে, নিচ ও দ্বিতীয় তলার কিছু অংশ ছিল ডেকের যাত্রীদের জন্য। আর দ্বিতীয় তলার অর্ধেক অংশ এবং তৃতীয় তলার পুরোটাই ছিল কেবিন যাত্রীদের জন্য।

অভিযান-১০ লঞ্চে সিঙ্গেল ও ডাবল মিলিয়ে শতাধিক কেবিন ছিল। এসব কেবিনে পাঁচতারকা মানের হোটেলের মতো সব ধরনের আয়োজনও ছিল। শুধু পর্যাপ্ত ছিল না অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও জরুরি মুহূর্তে পানিতে লাফিয়ে জীবন বাঁচানোর বয়া।

ডেকের যাত্রীদের জন্য নিচ ও দ্বিতীয় তলায় ৫০টিরও কম বয়া ছিল। দ্বিতীয় তলার কেবিন ব্লকে দুই পাশ মিলিয়ে ৮-১০টি বয়া রাখার স্থান ছিল আর তৃতীয় তলায় ৫৮টি সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনের জন্য সব মিলিয়ে ২০টি বয়া রাখার স্থান ছিল। অর্থাৎ শতাধিক কেবিনের জন্য মাত্র ৩০টি বয়া রাখার স্থানের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার বয়াগুলো রাখা ছিল অন্তত ১২ ফুট উচ্চতায়। তাও আবার শক্ত করে বাঁধা, যা ছিল নাগালের বাইরে।

হাজারের বেশি যাত্রী বহনকারী বিলাসবহুল অভিযান-১০ যাত্রী সেবায় আকৃষ্ট করলেও উপেক্ষিত থেকে গেছে যাত্রীদের জীবন রক্ষার বিষয়টি। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র যেন আরেক শুভঙ্করের ফাঁকি। পুরো লঞ্চটিতে মাত্র তিনটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পাওয়া গেছে। সেটিও ইঞ্জিন রুমের পাশে।

এছাড়া লঞ্চের রান্নাঘর ছিল ইঞ্জিন রুমের মাত্র ১০ ফুটের মধ্যে, চায়ের ক্যান্টিন ছিল ১৫ ফুটের মধ্যে। ছিল না জরুরি মুহূর্তে বের হওয়ার কোনো উপায়। লঞ্চ থেকে যাত্রীদের বের হওয়ার প্রধান দরজাটি তিন ফুটেরও কম। সেখান দিয়ে একসঙ্গে দুজন মানুষ বের হওয়াই কষ্টকর।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পানির লাইনের ব্যবস্থা থাকলেও ছিল না ব্যবহারের ব্যবস্থা। এমনকি আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পরও অব্যবহৃত থেকে গেছে সেই পানির লাইন।

বিলাসবহুল অভিযান-১০ লঞ্চে ছিল পদে পদে অনিয়ম

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অভিযান-১০ লঞ্চটি ২০১৯ সালে নিবন্ধিত হয়। এর মালিক সূত্রাপুরের বাসিন্দা মো. হাম জামাল শেখ নামের এক ব্যবসায়ী। লঞ্চটিতে ১২৫টি লাইফ বয়া, ২২টি লাইফ জ্যাকেট, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ২০, বালুভর্তি বালতি ১৫টি ও ১টি বালির বক্স থাকার কথা। বয়াগুলো যাত্রীদের হাতের নাগালে ও প্রকাশ্যে রাখার নিয়ম আছে। যেন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি নিয়ে যাত্রীরা পানিতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারেন।

উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, একটি বয়া ধরে ছয়-সাতজন যাত্রী পানিতে ভেসে থাকতে পারে। সে অনুযায়ী, ৩১০ জন যাত্রী থাকলে সবাই পানিতে ঝাঁপ দিলেও বয়ার সংকট হতো না। কিন্তু বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা অনেকেই জানিয়েছেন, লঞ্চটি আগুন লাগার পর প্রায় এক ঘণ্টা পানিতে চলমান অবস্থায় ছিল। যারা সাঁতার জানতেন তারা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। আর অনেকেই বয়ার খোঁজে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেছেন। কেউ পুড়ে মারা গেছেন। কেউ পানিতে ডুবে গেছেন। একপর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামের তীরে লঞ্চটি ভাসা অবস্থায় আটকে গেলে দ্রুত নামতে গিয়ে যাত্রীদের অনেকে আহত হন।

জুম্মান নামে লঞ্চের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বলেন, আমি নিচতলার ডেকের সামনের দিকে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে দেখি আগুন আর আগুন। সাঁতার জানলেও মাঝ নদীতে কতক্ষণ আর ভেসে থাকা যায়। তাই পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য একটি বয়া খুঁজছিলাম। কিন্তু দেখি, কোথাও বয়া নেই। যে কটি ছিল, তার কয়েকটা নিয়ে অনেক আগেই মানুষ পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। বাকিগুলো এতোই শক্ত করে বাঁধা ছিল যা কেউ টেনেও ছুটাতে পারেনি। এ অবস্থায় লঞ্চের একেবারে সামনে অপেক্ষা করতে থাকি। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। পরে লঞ্চটি তীরের কাছাকাছি গেলে লাফিয়ে পানিতে নেমে প্রাণ বাঁচাই।

রোববার দুপুর ১২টার দিকে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শনে যান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও ম্যানটেনেন্স) লেফটেনেন্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ ও সুগন্ধা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখেন তিনি। এ ঘটনার জন্য লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে দুষছেন তিনি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জিল্লুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ড এমন একটা দুর্ঘটনা, যাতে ক্রাইমসিন আলামতগুলোও নষ্ট করে দেয়। তবে মনে হয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাবধানতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এতো পরিমাণে হতাহত হয়েছে। আগুন লাগার পরে নির্বাপণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লাইফ জ্যাকেট ও বয়া পর্যাপ্ত না থাকলেও যা ছিল তা ব্যবহারে সরবরাহ করা হয়নি। যখন আগুন লেগেছে এরপরও এক ঘণ্টার বেশি সময় লঞ্চ চালিয়েছে। শুরুতেই যদি কোনো তীরে ভিড়ানো হতো তাহলে ক্ষয়-ক্ষতি এতো বেশি হতো না। জানমাল রক্ষা পেতো।

আতিকুর রহমান/এসজে/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।