সুনামগঞ্জে কমছে দেশি পাখি, হাওরে আসে না পরিযায়ী

লিপসন আহমেদ লিপসন আহমেদ , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৫:৫৬ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১

হাওর-বাঁওড়ের জেলা সুনামগঞ্জ। এক সময় এ জেলাকে দেশীয় পাখির রাজ্য বলা হতো। কিন্তু গ্রামগঞ্জের বাসাবাড়ি আধুনিকায়নের ফলে কমেছে দেশীয় পাখির আশ্রয়ের ঠিকানা। আবার কীটনাশকযুক্ত ফসল খেয়েও মারা যাচ্ছে পাখি। ফলে সুনামগঞ্জে কমছে দেশীয় পাখি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই ঝাউ-জঙ্গল কাটছে। সবার ঘরবাড়ি মাটির ঘর থেকে দালান হচ্ছে। ফলে পাখিরা বাসস্থান হারিয়ে ছুটছে অন্যত্র। ফলে পাখির কিচিরমিচির ডাকে এখন আর ঘুম ভাঙে না স্থানীয়দের।

গ্রামের প্রবীণরা বলেন, আগেও মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-খামারে বিচিত্র পাখির বিচরণ ছিল। পাখিরা সে সময় ঝাঁকে ঝাঁকে খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। তখন ফসলের মাঠে পাখি বসার দৃশ্য সচরাচর দেখা গেলেও এখন তা পাওয়া যায় না। অতীতে গ্রাম এলাকায় ব্যাপকহারে টুনটুনি, চিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, বালি হাঁস, কোকিল, বক, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, বাবুই, কাকসহ বিভিন্ন পাখির দেখা মিলতো। বর্তমানে জাতীয় পাখি দোয়েল, কাঠ ঠোকরা, কোকিল, ডাহুক, বাবুই, ঘুঘু, বাওয়াই, শালিক, টুনটুনি, মাছরাঙা, টেইটেরা, গোমড়া ও প্যাঁচাসহ অনেক পাখি আর তেমন দেখা যায় না। শোনা যায় না এসব পাখির ডাক। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত বসন্তে যে পাখি ‘বউ কথা কও’ বলে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে মাতিয়ে রাখতো সেই পাখির দেখা আর পাওয়াই যায় না। ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই চেনে না এসব পাখি। ফলে শিশু-কিশোরদের কাছে দিন দিন হয়ে যাচ্ছে এসব পাখি ইতিহাস।

বিশেষজ্ঞরা জানান, গ্রামগঞ্জে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার পাখি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দায়ী। কৃষকরা বিভিন্ন ফসলে সব সময় কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালীসহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ মারা যায় বা রোগে আক্রান্ত হয়। পাখি দিনের পর দিন এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়া শিকারিদের নিষ্ঠুরতা তো রয়েছেই। ফলে পাখির বিলুপ্তির কারণে যেমন জীববৈচিত্রের সংকট বাড়ছে, তেমনি হারিয়ে ফেলছে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ।

jagonews24

সদর উপজেলার বাধেরটে গ্রামের বাসিন্দা ৭৯ বছরের মদরিছ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমার বয়স যখন ১০ তখন গ্রামে কত রঙের পাখি ছিল তা বলে শেষ করতে পারব না। ঘরের চালে পাখি বাসা বাঁধতো। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙত। অথচ এখন আর সেই পাখি নেই।

গ্রামের বাসিন্দা আনিস উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, আগে মাঠে ফসল ফলানোর সময় চারদিকে পাখি বসে থাকতো। কিন্তু এখন মাঠ আছে, ফসল আছে, গ্রাম আছে অথচ সেই পাখি নেই।

গ্রামের বাসিন্দা ঝুনাকি বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আগে যখন পুকুর থেকে পানি আনতাম তখন পুকুরের চারপাশে কত পাখি থাকতো, পাখিরা কিচিরমিচির করত। অথচ এখন পাখিই তেমন দেখা যায় না।

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমেল আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, গ্রামের চারদিকে ঘনবসতির কারণে পাখি এখন আশ্রয়স্থল হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কীটনাশকযুক্ত ফসল খেয়ে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। পাখি রক্ষার্থে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আবারও পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাবে।

এদিকে শীতের শুরুতেই সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝাঁক বেঁধে আসতো অতিথি পাখি। পাখির শব্দে তখন হাওর পাড়ের মানুষের ঘুম ভাঙতো। পাখি দল বেঁধে এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে উড়াল দিলে ঝড়ের মতো শব্দ বাড়ি থেকেও শোনা যেত। কিন্তু সেই শব্দ কয়েক বছর ধরে আর শোনা যায় না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসিস ঈগল রয়েছে। কালেম, পানকৌড়ি, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁস, খয়রাবগা, লেঞ্জাহাঁস, নেউপিপি, সরালি, রাজসরালি, চখাচখি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা, মরিচা ভূতিহাঁস, সাধারণ ভূতিহাঁস, শোভেলার, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, ডাহুক, বেগুনি কালেম, গাঙচিল, শঙ্কচিল, বালিহাঁস, ডুবুরি, বক, সারসসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি।

২০১১ সালের জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৬৪ হাজার পাখির অস্তিত্ব ছিল। এতে দেশি জাতের ৮৬ এবং ৮৩ জাতের বিদেশি পাখি ছিল। বর্তমানে এগুলোর দেখা একবারেই মিলছে না।

টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের বাসিন্দা খালেদ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, অতিথি পাখি প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে আসতো। হাওরে জলকেলি আর দল বেঁধে গাছের ডালে সঙ্গিনী নিয়ে উড়াউড়ি করতো। অথচ কয়েক বছর ধরে হাওরে পাখিই আসে না।

jagonews24

হাওর পাড়ের বাসিন্দা কয়েস মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ছোটবেলা কত জাতের পাখি যে হাওরে দেখিছি তার ইয়ত্তা নেই। তবে এখন একবারেই পাখি আসে না।

টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের আরেক বাসিন্দা মনোয়ার আলী জাগো নিউজকে বলেন, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়, উত্তর এশিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে অতিথি পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। অথচ পাখি শিকারিদের নিষ্ঠুরতা কারণে এসব পাখিও এখন আর আসে না।

অধ্যাপক ড. রুমেল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, হাওরের পাখি শিকারিদের সাজা দিয়ে কোনো লাভ হয় না। কারণ সাজা শেষে আবারও তারা পাখি শিকার শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, যদি পাখি শিকারিদের কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে হয়তো টাঙ্গুয়ার হাওরে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে বেশি বেশি পাখি আসত।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখি যাতে কেউ শিকার না করতে পারে সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্টদের নীবিড়ভাবে হাওর তদারকি করতে নির্দেশ দেয়া আছে। যে পাখি শিকার করবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।

লিপসন আহমেদ/এএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।