শুঁটকির ক্ষতিকর মাছি ঠেকাবে বন্ধ্যামাছি
ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব কমিয়ে কীটনাশকমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর শুঁটকি উৎপাদন নিশ্চিত করতে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে ছাড়া হয়েছে দুই লাখ বন্ধ্যা মাছি। গবেষণাগারে উৎপাদিত এই বন্ধ্যামাছি দিয়েই দমন করা হবে শুঁটকির জন্য ক্ষতিকারক বন্যমাছি। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. এ টি এম ফয়েজুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী বুধবার (১ ডিসেম্বর) সোনাদিয়া দ্বীপে এই বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করেন।
এসময় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান, বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহসিনা ইয়াসমিন, মো. শাহিনুর ইসলাম, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন এবং বৈজ্ঞানিক সহকারী মো. আবুল কালাম আজাদসহ স্থানীয় শুঁটকি উৎপাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় শুঁটকি উৎপাদক হাসমত উল্লাহ জানান, ২০০৭ সালেও সোনাদিয়া দ্বীপে ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব কমাতে বন্ধ্যা মাছি ছাড়া হয়েছিল। এরপর ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব একদম কমে যায়। শুঁটকির উৎপাদন ও গুণগত মানও বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় আরেক শুঁটকি উৎপাদক নুর হোসেন বন্ধ্যা মাছির উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ওই বছর (২০০৭ সালে) বন্ধ্যামাছি ছাড়ার কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে কীটনাশকমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর শুঁটকি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এতে শুঁটকির মূল্যও পাওয়া যায় আগের তুলনায় দ্বিগুণ। ১৪ বছর পর নতুন করে বন্ধ্যামাছি ছাড়ার কারণে এ মৌসুমে গুণগত মানের শুঁটকি উৎপাদন অনেক বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।
আগামী সপ্তাহে দেশের বৃহত্তম শুঁটকিপল্লী কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেকে আরও বড় পরিসরে বন্ধ্যামাছি অবমুক্ত করা হবে বলে জানান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ফয়েজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মাছি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কক্সবাজারে শুঁটকির উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এরই মধ্যে শহরের কলাতলীতে অবস্থিত সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে একটি গবেষণাগার ও প্রযুক্তি কেন্দ্র। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্ভাবিত এই পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিবছর শুঁটকির উৎপাদন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন (১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন) সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ মাছকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুটকিতে রূপান্তর করা হয়। তবে মাছ রোদে শুকানোর সময় লিওসিনিয়া কাপ্রিয়া নামের এক প্রজাতির ক্ষতিকারক মাছির আক্রমণে প্রায় ৩০ শতাংশ শুঁটকিই নষ্ট হয়ে যায়। এরমধ্যে দেশের বৃহত্তম শুঁটকি মহাল নাজিরারটেকেই নষ্ট হয়ে যায় বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুঁটকি।
এই মাছির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাছে বিষ অথবা অতিরিক্ত লবণ প্রয়োগ করছেন শুঁটকি উৎপাদকরা। এতে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে শুঁটকির গুণগত মানও কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাজারমূল্য কমে যাচ্ছে এবং শুঁটকি মাছ বিদেশে রফতানি করা যাচ্ছে না।
এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ‘মাছি বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি’র মাধ্যমে শুঁটকি মাছের ক্ষতিকর পোকা দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বলে জানান গবেষক ড. এ টি এম ফয়েজুল ইসলাম।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বন্ধ্যাকরণ এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিরকারক মাছির বংশবৃদ্ধি কমিয়ে শুঁটকির উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই, সহজ ও স্বাশ্রয়ী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব হবে। যার দরুন দেশীয় বাজারে শুঁটকির চাহিদা বেড়ে যাবে। শুঁটকি উৎপাদনকারীরা চড়া বাজারমূল্য পাবেন। অন্যদিক বিষমুক্ত ও নিরাপদ এই শুঁটকি বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব বলে মনে করেন এই গবেষক।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি এক ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি উল্লেখ করে ড. ফয়েজুল বলেন, এ পদ্ধতিতে কোনো এলাকায় বন্যমাছির কয়েকগুণ বন্ধ্যামাছি ছাড়া হয়। এরপর বন্ধ্যামাছির সঙ্গে ক্ষতিকর মাছির মেলামেশায় যে ডিম জন্ম হয়, তা থেকে আর বাচ্চা ফোটে না। এভাবে ধীরে ধীরে সেই মাছির বংশ কমে যায়। তবে ক্ষতিকর মাছি নিয়ন্ত্রণে প্রতি দুই মাস অন্তর একবার করে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে বলে জানান তিনি।
বিজ্ঞানীরা জানান, সোনাদিয়া ও নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে চার প্রজাতির মাছি দেখা যায়। এরমধ্যে কেবল লিওসিনিয়া কাপ্রিনা প্রজাতির মাছিই শুঁটকিতে ডিম পেড়ে শুঁটকি নষ্ট করে দেয়। এই প্রজাতির মাছিকে বন্য পরিবেশ থেকে ধরে এনে গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গণউৎপাদন করা হয়। ডিম থেকে শুক্রকীট, এরপর পিপাসহ চারটি পর্যায় অতিক্রম করে মাছি পূর্ণ বয়স্কে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পুরুষ মাছিগুলোকে তৃতীয় পর্যায়ে বা পিপা পর্যায়ে থাকা অবস্থায় গবেষণাগারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গামা ও এক্স-রে রশ্মির বিকিরণ প্রয়োগ করা হলে তারা বন্ধ্যা হয়ে যায়। কোনো এলাকায় ক্ষতিকর মাছিমুক্ত করার জন্য এই মাছির দ্বিগুণ বা তারও বেশি সংখ্যায় বন্ধ্যামাছি ছেড়ে দেওয়া হয়।
সায়ীদ আলমগীর/এসআর/এমএস