আগাছায় ভরা প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি
#যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ক্রমেই বাড়ছে দর্শনার্থী
#নিরাপত্তা, শৌচাগার ও বাল্ব স্থাপন জরুরি
#সংস্কারহীনতায় ভেঙে পড়ছে প্রাচীনতম ভবনের ইট ও পলেস্তারা
সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় ক্রমেই ঐতিহ্য হারাচ্ছে ফেনীর প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি। ঐতিহাসিক এ বাড়িটি সংস্কারহীনতায় জরাজীর্ণ হয়ে আগাছায় ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হচ্ছে। তারপরও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বাড়িটি এক নজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী আসছে প্রতিদিনই। জমিদারদের রেখে যাওয়া নিদর্শনগুলো দেখতে আশপাশের জেলা ও উপজেলার মানুষও ভিড় জমান এ বাড়িতে।
তবে নিরাপত্তা, শৌচাগার ও বৈদ্যুতিক বাল্ব না থাকায় সন্ধ্যার আগেই এ বাড়ি ছাড়তে হয় দর্শনার্থীদের। এছাড়াও দীর্ঘদিন সংস্কারহীনতা ও পরিচ্ছন্নতার কাজ না হওয়ায় এ বাড়িটি ক্রমেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দ্রুত বাংলার জমিদারী প্রথার নিদর্শন হিসেবে বাড়িটি সংস্কার করে পর্যটনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার দাবি দর্শনার্থীদের।
দর্শনাথীরা জানান, ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ঐতিহাসিক ও প্রাচীন নিদর্শন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি অনেক গুরুত্ববহন করে। এখানকার দালান-কোঠা দেখতে অনেকটা নারায়ণগঞ্জের পানাম সিটির মতোই। ফলে কম সময়েই ফেসবুক ও ইউটিউবে বাড়ির ঐতিহ্য শুনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন।
জানা গেছে, বাংলা ১২২৮ সালের ১৩ ফাল্গুন রামনাথ কৃষ্ণ সাহা ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামে এ জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের কাছে এটি বড়বাড়ি ও রাজবাড়ি নামেই পরিচিতি। প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গায় নির্মিত রাজপ্রসাদসম এ বাড়িতে রয়েছে পাচঁটি অভিজাত ডিজাইনের দ্বিতল ভবন। ওই ভবনে রামনাথসহ তারা পাঁচ ভাই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
ঘরগুলোর চারপাশে খনন করা ১২টি পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে জমিদাররা মাছ চাষ করতেন। পুকুরগুলোতে পাঁচটি দৃষ্টিনন্দন বৈঠকখানাবেষ্টিত ঘাটলায় জমিদারদের পাঁচ পরিবারের বউ-ঝিরা গোসল ও গল্প করতেন। জমিদারী আমলে দেশ-বিদেশের অন্যান্য জমিদাররা এ বাড়িতেই সফর বিরতি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
স্থানীয়রা জানান, একটা সময় মাঠের ধানে ভরে যেত জমিদার বাড়ির উঠান–গোলা আর কাচারি ঘর। ধান ওঠানো শেষে শুষ্ক মৌসুমে সেই জমিতে চাষ হতো সরিষা, মটরশুটি, খেসারি, কলাই ও মুসরিসহ বিভিন্ন রবিশস্য। ঘোড়ায় চড়ে জমিদাররা যাতায়াত করতেন এবাড়ি-ওবাড়ি। সিন্দুরপুর ও রাজাপুর এলাকায় পরিষদ ভবনে বসে ১০ তালুকের খাজনা আদায় করতেন তারা। সেই খাজনা জমা দিতেন সরকারি কোষাগারে। এ জমিদার বাড়ির ঈশারায় ওঠবস করতেন আশপাশের এলাকার মানুষ।
১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর এ পরিবারটির ক্ষমতা-দাপট কমতে থাকে। তারপরও দীর্ঘ ৪৮ বছর পর্যন্ত তারা এ বাড়িতে থেকেই নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ১৯৯৮ সালের দিকে ওই বাড়িতে কয়েকবার হামলা ও লুটপাট হওয়ার পর জমিদারের ওয়ারিশদের মাঝে ভয় কাজ করতে থাকে।
একপর্যায়ে তারা নিরাপত্তার অভাব, ব্যবসায়িক সমস্যা ও যোগাযোগ সমস্যার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ভারতের ত্রিপুরা ও কলকাতায় চলে যান। যাওয়ার সময় তাদের সব জমি ও পুকুরগুলো স্থানীয় কৃষকদের মাঝে বর্গা দেন। পূর্বের ধারাবাহিকতায় এখনও প্রতি বছর ওই বাড়িতে দুই দিনব্যাপী মেলার আয়োজন হয়। মেলায় জমিদারদের বংশধরেরা আসেন। উৎসবে চলে জমিদার বাড়ির স্মৃতিচারণ, পুঁথি পাঠ ও গল্প পাঠের আসর। উৎসব শেষে জমিদারদের তৃতীয় বংশধরেরা স্থানীয় কৃষকদের থেকে বর্গা চাষের টাকা নিয়ে চলে যান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িতে ঢুকতেই নজর কাড়বে একতলা ও দোতলা ভবনের কাঁচারি ঘর। তার একটু সামনেই রয়েছে ছোট্ট একটি ঠাকুর ঘর। পাশেই পুকুর পাড়ে স্থাপিত ভাঙাচোরা বৈঠক খানা ও ঘাটলা। সামনে তাকালে দুটি দৃষ্টিনন্দন দালান। ওই দালানের মাঝ দিয়ে সরু গলি পেরুলেই দেখা মিলবে একটি বড় উঠান। উঠানের তিন পাশে দাঁড়িয়ে আছে ৩টি তৎকালীন অভিজাত দালান।
তার আশপাশেই রয়েছে ইট, সুড়কি ও রড দিয়ে তৈরি আরও কয়েকটি দালান। এসব দালানের দেয়াল খসে গেছে অনেক জায়গায়। ইটের স্তর ভেদ করে কোথাও গজিয়ে গেছে পরজীবী গাছ। কোনো কোনো ভবনের উপরিভাগ ক্ষয়ে গেছে সেই অনেক আগেই। শ্যাওলা জমে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। সিলিং লোহার এইচ বিমের ওপর স্তম্ভ, খিলান দেয়াল সবই ইট আর সুরকির স্বল্প আয়ুর চিহ্ন বহন করে চলেছে। যে কোনো সময় ভেঙে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে এখানে।
রাজশাহী থেকে আগত দর্শনার্থী মোমিনুল হক জানান, উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি সম্পর্কে জানতে পেরে এটি দেখার শখ জাগে। তাই ৮ বন্ধু মিলে মাইক্রোবাস নিয়ে এখানে এসে খুব ভালোই লাগছে। এখানকার সৌন্দর্য্য-ঐতিহ্য ও যাতায়াত ব্যবস্থা আমাদের খুবই মুগ্ধ করেছে। তবে এখানে শৌচাগার ও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার আগেই পর্যটকদের ওই এলাকা ত্যাগ করতে হয়। বাড়িটি সংস্কার করে এখানে পর্যটনবান্ধন পরিবেশ গড়ে তোলার দাবি জানান দর্শনার্থীরা।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী হারুন অর রশীদ মৃধা জানান, সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎহীন বাড়িটিকে ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়। দীর্ঘদিন সংস্কার ও পরিষ্কার না করায় বাড়িটির ভবনগুলোসহ চারপাশে আগাছা ও বনজঙ্গলে ভরে গেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার তানিয়া জানান, বাড়িটি এখনও জমিদারদের ওয়ারিশদের মালিকানায় রয়েছে। ফলে সরকারিভাবে এখানে সংস্কার বা অন্য কিছু করা যাচ্ছে না। এর আগে জমিদারদের নাতিদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা হলেও তাদের থেকে কোনো সাঁড়া পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানতে পেরেছেন। বাড়িটির বিষয়ে জমিদারদের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান জানান, প্রতাপপুর জমিদার বাড়ির বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়িটির ঐতিহ্য রক্ষা ও পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআরএম/এএসএম