বগুড়ায় আতঙ্কিত ভোটাররা


প্রকাশিত: ১১:১৫ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

বগুড়ার ৯টি পৌরসভায় ১৭৩ কেন্দ্রের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৫টি। আর ঝুঁকি হতে পারে এমন সংখ্যাও ৩০এর উপরে। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কেন্দ্রে নিয়ে পুলিশই আতঙ্কিত। পুলিশের এই আশঙ্কা যেন অবচেতন মনেই ভর করেছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও।

ভোট গ্রহণের আগেই হুমকি, ধামকি, হামলা, শো-ডাউন তাদের এই আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। আর সে কারণে নির্বিঘ্নে ভোট দেয়া নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তারা।

বগুড়া সদরের ৯নং ওয়ার্ড বগুড়া খান্দার এলাকার একটি চায়ের স্টলে চলছিলো সাধারণ মানুষের আড্ডা। আলোচনা হচ্ছিলো পৌর নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ষাটোর্ধ্ব ফয়েজ উদ্দিন বলে উঠলেন, এ রকম নির্বাচন এ জীবনে দেখিনি। কথা কেড়ে নিয়ে কৃষক জসিম উদ্দিন বললেন, দল বেধে বাড়ি বাড়ি আসছে। প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি থাকছে তাদের কথায়। যেন ভোট না দিলে খেয়ে ফেলবে।

স্কুল শিক্ষক রমজান আলী অবশ্য বললেন ভিন্ন কথা। যেহেতু এবার প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে সে কারণে নির্বাচনের দিন কিংবা আগে-পরে সহিংসতা বাড়তে পারে। এ নিয়ে অনেক আতঙ্ক রয়েছেন বলে জানালেন তিনি।

নির্বাচনকে ঘিরে গত কয়েক সপ্তাহে বগুড়ায় বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও নির্বাচনকে ঘিরে এসব এলাকায় নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলেও এবারের মাত্রা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সদরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাড. মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করে বলেছেন, বিভিন্ন এলাকায় তার কর্মীদের উপর হামলা, মারপিট করা হচ্ছে। পোস্টারে আগুন লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে যাতে ধানের শীষে ভোট না দেয়।

একই ধরনের অভিযোগ করেছেন বিএনপি সমর্থিত ১০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মাহবুবর রহমান লুলকা। তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হুমকি দিয়েছে আওয়ামী কর্মীরা। এ ঘটনায় তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জেলা রিটানিং কর্মকর্তা। ১৫ নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী কারারুদ্ধ মাসুদ রানার স্ত্রী রেহেনা বেগম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় একই ওয়ার্ডের সরকার দলীয় প্রার্থী আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে বাধা প্রদানসহ কর্মীদের মারপিটের অভিযোগে এনেছেন। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ভোট সম্পন্ন করতে এই ওয়ার্ডের ৭টি কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানান।

বগুড়া ৪নং ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হলেন তাজুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী সামসুদ্দীন শেখ হেলালের কর্মীরা তার নেতাকর্মীরা ছাড়াও সাধারণ ভোটারদের হুমকি ধামকি দিচ্ছে। ভোট না দিলে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হবে না এমন কথাও ছড়ানো হচ্ছে। তবে সামসুদ্দীন শেখ হেলাল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, এসব মিথ্যা ভিত্তিহীন।

সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে শুধু সদরেই ১০১টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৭০টি, গাবতলীতে ৯টির মধ্যে ৭টি, কাহালুতে ৯টির মধ্যে ৫টি, নন্দীগ্রামে ৯টির মধ্যে ৫টি, শেরপুরে ৯টির মধ্যে ৫টি, ধুনটে ৯টির মধ্যে ৬টি, সারিয়াকান্দিতে ৯টির মধ্যে ৮টি, সান্তাহারে ৯টির মধ্যে ৫টি এবং শিবগঞ্জ পৌরসভায় ৯টির মধ্যে ৫টি ভোটকেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। আর এসব সহিংসতার জন্য মেয়র প্রার্থীর চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীর নেতাকর্মীরাই এগ্রেসিভ বেশি। তবে জেলার ৩টি পৌরসভার মধ্যে বগুড়া সদর, কাহালু, ধুনট, সারিয়াকান্দি ও নন্দ্রীগ্রামে মেয়র পদে কর্মী সমর্থকদের কারণে সাধারণ ভোটাররা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ভোট চাওয়ার নামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করা এর একটি কারণ।

তারা মনে করেন, বিজয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ও ত্রিমুখী সংঘর্ষ হতে পারে। এজন্য বড় দুই দলের চিহ্নিত অনেক সন্ত্রাসী নির্বাচনী মাঠে নেমেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এরাই ৩০ ডিসেম্বর বিভিন্ন কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ নানা ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কা গোয়েন্দা পুলিশের কাছেও রয়েছে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান জানান, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ না করে কেন্দ্র দখল বা ব্যালট ছিনতাই এর মতো ঘটনার সৃষ্টি হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়ার জন্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন ইসি। পুলিশও যে কোন ধরনের অপতৎপরতা রোধে সজাগ রয়েছে। যে কোন ধরনের সহিংসতা রোধ করা হবে।

বগুড়ার কয়েকটি পৌর এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ধারণা সংঘর্ষ হতে পারে বড় দুই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেন্দ্রগুলো ঘিরে। বিশেষ করে সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের এলাকায় ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যেও সংঘাত হতে পারে।

বগুড়ার একজন প্রবীণ সমাজসেবী মকলেছুর রহমান বললেন, যেখানে নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই হবে সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ নিতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেক্ষেত্রে সংঘর্ষ হবে ত্রিমুখী। আর বগুড়ার বেশির ভাগ পৌরসভাতেই কমবেশি বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। এরা কেউই চাইবে না নিরবে হেরে যেতে।

স্থানীয় ভোটারদের মতে, বেশ কিছু এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রার্থীর (বিদ্রোহী ও নৌকা প্রতীক) মধ্যে টানটান উত্তেজনায় ভোট হবে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে আছে খোদ সরকার। আর বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে গোপনে আছেন স্থানীয় এমপি। এ কারণে ক্ষমতার পাল্লা কোনো দিকেই হালকা নয়।

স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোট গ্রহণের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচনী এলাকাগুলোতে উত্তেজনা ততই বেড়েই চলছে। নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে বেশিরভাগ প্রার্থী আশপাশ এলাকার সন্ত্রাসী-মাস্তানদের গোপনে ভাড়া করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।

নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী বগুড়ায় সম্প্রতি বৈঠক করে বলেছেন, অর্পিত দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন বদ্ধ পরিকর। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পৌরসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পুলিশকে নির্দেশ দেয়া রয়েছে প্রয়োজনে তারা অস্ত্র ব্যবহার করবে। অবৈধ পন্থায় ভোট নেয়ার চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভোটারদের নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগে সার্বিক সহযোগিতা করবে। তার এই বক্তব্য থেকেও একটি বিষয় বোঝা যায় যে, সহিংসতার আশঙ্কা এই জেলায় রয়েছে।

বগুড়ার রিটানিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হায়াত উদ দৌলা বলেন, ভোট গ্রএণর দিন পুলিশ, র্যাব, আনসার মাঠে নামছে। প্রয়োজনে বিজিবিও নামানো হবে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক জুডিসিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের মূল্যবোধ মেনে আচরণ করলে নির্বাচন ভালো হবে। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। কেউ ওই নির্দেশ অম্যান্য করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

লিমন বাসার/এসএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।