তিনফসলি জমি অনাবাদি দেখিয়ে অধিগ্রহণের চেষ্টা, কৃষকদের ক্ষোভ
ফেনীর সোনাগাজীতে ২০৭ একর কৃষি জমিতে ‘সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তিনফসলি জমি অধিগ্রহণ শুরু করায় স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে ওই জমি অধিগ্রহণ করতে এসে ফসলি জমি দেখে পিছু হটেন।
স্থানীয়রা বলেন, প্রকল্প এলাকার জমিগুলোতে বছরে দুই থেকে তিন ফসল তোলা হয়। কিন্তু সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ম্যানেজ করে কৃষি জমিকে অকৃষি দেখিয়ে অধিগ্রহণের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করে সোনাগাজী সোলার পাওয়ার। ফসলি জমি রক্ষায় নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চার থেকে পাঁচ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের খোয়াজ লামছি এলাকায় বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি ৪৫৯ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। পরে মাঠ পর্যায়ে এসে অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত ভূমি ফসলি হওয়ায় প্রকল্প স্থাপন না করে চলে যান। সম্প্রতি ওই ভূমির ২০৭ একর জুড়ে সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু করেছে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে ভূমি অধিগ্রহণে অনাপত্তি সনদও আদায় করেছে ওই কোম্পানি। পরে প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করে পতাকা লাগানোর পর বিষয়টি স্থানীয় কৃষকদের নজরে আসে।
ভূমি মালিকদের অভিযোগ, পিডিবি ও স্থানীয় ভূমি অফিসকে ‘ম্যানেজ করে’ তিন ফসলি জমিকে পতিত জমি দেখিয়ে প্রকল্প স্থাপনের অপচেষ্টা চালাচ্ছে একটি অসাধু চক্র।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দে সোনাগাজীতে সোলার প্রকল্প স্থাপিত হচ্ছে। জার্মান ভিত্তিক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০ বছরের জন্য প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক পত্রে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মুহুরি প্রজেক্ট এলাকায় জেগে ওঠা চর কিংবা জেগে উঠতে পারে এমন জমি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া যাবেনা বলে নির্দেশ জারি করা হয়।
প্রকল্প এলাকার ফসলি ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন ও সদস্য সচিব মোশারফ হোসেন জানান, আমাদের জীবন যেতে পারে। কিন্তু ফসলি জমি বিক্রি করবো না। জমি রক্ষা করতে আমরা তিনবার শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন করেছি। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পেতে স্মারকলিপি দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও কঠোর আন্দোলনের দিকে যাবো। কিন্তু ফসলি জমি নষ্ট হতে দেবো না।
প্রকল্প এলাকায় কৃষি বিভাগ অনাপত্তি জানিয়ে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট একটি পত্র জারি করে। ফেনীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক তোফায়েল আহমদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই পত্রে ২০৭ একর জমিকে লবণাক্ততার কারণে অনাবাদী রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে পত্রে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ভূতাপেক্ষভাবে উক্ত সম্পত্তিগুলো কৃষি কাজে ব্যবহার হয়না বলে সোলার কোম্পানিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া কৃষি বিভাগের এ প্রতিবেদনটি মিথ্যা ও অসত্য দাবি করে প্রতিবাদ করে ওই এলাকার মানুষ।
সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামছুল আরেফিন জানান, প্রকল্প এলাকায় প্রায় সব জমিই তিন ফসলি। এসব এলাকায় কীভাবে প্রকল্প স্থাপনে অধিগ্রহণের অনুমোদন পায় সেটা আমার বুঝে আসেনা। এখানে প্রকল্প স্থাপন হলে বর্গা চাষিসহ অন্তত পাঁচ হাজার কৃষক বেকার হয়ে পড়বে।
সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আবু মেহেদী মোবাইলে জানান, প্রকল্প এলাকায় তিন ফসলি কোনো জমি নেই। আমরা ২০০৯ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইনে এক ফসলি জমি অধিগ্রহণ করছি। প্রকল্প এলাকার কৃষকদের ৪ গুণ পর্যন্ত দাম দিয়ে জমি কেনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান জানান, স্থানীয় কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর সোনাগাজী সোলার প্রকল্প স্থাপন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। এলাকা জুড়ে ধানক্ষেত দেখেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত ও অধিকতর খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নুরউল্লাহ কায়সার/আরএইচ/জেআইএম