সরকারি ভবনে আ’লীগ নেতার কিন্ডারগার্টেন
বরিশালের বাকেরগঞ্জে সরকারি ভবন দখল করে পরিচালনা করা হচ্ছে কিন্ডারগার্টেন। এই কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক পদে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অমল চন্দ্র দাস ওরফে শিবু।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাকেরগঞ্জ উপজেলা শহরের সদর রোডে ছিল থানা হাসপাতাল। বেশ কয়েক দশক আগে হাসপাতালটি সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় সাহেবগঞ্জ এলাকায়। পরর্তীতে সদর রোডের ওই জমিতে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য তিনতলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবনটি করার উদ্দেশ্য ছিল, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সেখানে থেকে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেবেন। কিন্ত অজ্ঞাত কারণে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বাকেরগঞ্জ না আসায় ভবনটি অব্যবহৃত ছিল।
জানা যায়, অব্যবহৃত থাকার সুযোগে স্থানীয় কিছু লোকজন ভবনটির বেশিরভাগ কক্ষ দখলে নিয়ে ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তীতে নিচতলার একটি ইউনিটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের কার্যালয় তৈরি করা হয়। আর ৮-৯ বছর আগে স্থানীয় লোকজনকে হটিয়ে ভবনটির কিছু অংশ দখল করে নেয় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক অমল চন্দ্র দাস ওরফে শিবু। এরপর থেকেই তিনি সেখানে কিন্ডারগার্টেনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, তিনতলা ভবনটির দোতলার পুরোটা আর নিচতলার একটি অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্ডারগার্টেনের অংশ হিসেবে। কারও অনুমোদন ছাড়াই প্রায় ৮ বছর ধরে এই ভবনটি ব্যবহার করছেন অমল চন্দ্র দাস। ভবনটির সামনে ঝুলানো রয়েছে কিন্ডারগার্টেনের নাম লেখা সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা রয়েছে ‘অংকুর কিন্ডারগার্টেন’। সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম লেখা রয়েছে লোকমান হোসেন ডাকুয়ার। তিনি বাকেরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। পাশাপাশি লোকমান হোসেন ডাকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আব্দুল হালিম জানান, ছয় মাস আগে বদলি হয়ে বাকেরগঞ্জে এসেছেন তিনি। তখন করোনার কারণে কিন্ডারগার্টেনটির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর পুনরায় ওই কিন্ডারগার্টেনে পাঠদান শুরু হয়েছে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে সকালের দিকে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী ওই কিন্ডারহার্টেনে পড়েতে আসে।
তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের নিজস্ব জমিতে কয়েক দশক আগে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের থাকার জন্য ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটির নিচতলার পশ্চিম পাশের ইউনিটে তার কার্যালয়। তৃতীয় তলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুইজন কর্মচারী বাস করেন। আর ভবনটির দোতলার সম্পূর্ণ ও নিচতলার একটি ইউনিট নিয়ে চলছে অংকুর কিন্ডারগার্টেনের কার্যক্রম।
আব্দুল হালিম আরও বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি ৭-৮ বছরের বেশি সময় ধরে ভবনটিতে কিন্ডারগার্টেনের কার্যক্রম চলছে। বিগত বিভিন্ন সময়ে সরকারি ভবন থেকে কিন্ডারগার্টেনটি সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্ত নানা কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।’
এ বিষয়ে কিন্ডারগার্টেনটির পরিচালক অমল চন্দ্র দাস ওরফে শিবু জানান, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বাকেরগঞ্জে না আসায় ভবনটি খালি ছিল। সেই সুযোগে কিছু লোক ভবনটির কক্ষ দখল করে রেখেছিল। সন্ধ্যার পর বসতো মাদকের আসর। কয়েক বছর আগে তাদেরকে হটিয়ে ভবনটির দোতলায় কিন্ডারগার্টেন চালু করেন তিনি। এসময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার মৌখিক অনুমতি নিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, তার সঙ্গে আরও দুই-তিনজন কিন্ডারগার্টেনটির পরিচালনার কাজে যুক্ত রয়েছেন। তাছাড়া কিন্ডারগার্টেনটির উপদেষ্টা পদে রাখা হয়েছে বাকেরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়াকে।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি অলাভজনক সেবামূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা করে মাসিক বেতন নেওয়া হয়। করোনাকালে প্রায় ১৮ মাস বন্ধ ছিল প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কিন্ডারগার্টেনটিতে ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী ও সাতজন শিক্ষক এবং দুইজন কর্মচারী রয়েছেন।’
এছাড়া কিন্ডারগার্টেনটি চালুর সময় ভবনটির বেহাল দশা ছিল দাবি করে অমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘ভবনের কক্ষগুলো জরাজীর্ণ ছিল। নিজ খরচে সেগুলো মেরামত করেছেন তিনি। এরপর প্রতিবছরই রং ও মেরামত করাতে হচ্ছে। তাছাড়া ভবনটিতো খালিই পড়ে ছিল। সেখানে সামান্য কিছু টাকার বিনিময় ছোট ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ভবন ছেড়ে দিতে বলা হলে কিন্ডারগার্টেনটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে।’
বাকেরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ডাকুয়া জানান, অংকুর কিন্ডারগার্টেন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত নেই। সম্মতি ছাড়াই সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার নাম লেখা হয়েছে। সাইনবোর্ড থেকে তার নাম মুছে দিতে প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে জানান তিনি।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শংকর প্রসাদ অধিকারী জানান, সম্প্রতি বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে এ বিষয় কেউ লিখিত কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশালের বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে এখন জানার পর খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
সাইফ আমীন/ এফআরএম/জিকেএস