মাদারীপুরে প্লাবিত ২৪ স্কুল, সহসা খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই
কয়েকদিন ধরে টানা বাড়ছে পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি। এতে তলিয়ে গেছে মাদারীপুরের নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন ৩০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। তলিয়ে গেছে জমির ফসল। পানিতে ডুবে আছে ২৪টি স্কুল।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ভাগ্যকূল পয়েন্টে পাঁচ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এতে আড়িয়াল খাঁসহ আরও কয়েকটি নদ-নদীর পানিও বেড়েছে। আগামী আরও পাঁচ দিন পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিবচরে চরাঞ্চলের পানি বিপৎসীমার তিন ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সরেজমিনে শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা, চরজানাজাত, কাঠালবাড়ি, সন্যাসীরচর, শিরুয়াইল দক্ষিণ-বহেরাতলাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায় পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এসব এলাকার অন্তত ৩০টি গ্রামের ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কিছু কিছু এলাকায় নদী ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে ঘর-বাড়ি, মসজিদ, স্কুল কলেজে ও ফসলি জমি।
শিবচর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার নিম্নাঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নের ২৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে নিমজ্জিত। তলিয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার রাস্তা-ঘাট। বিদ্যালয়গুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয় পানির ওপর ভাসছে। এর মধ্যে নবনির্মিত ১৫৬ নং খাসচর বাচামারা আজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে। ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটি এখনও উদ্বোধনই হয়নি। বন্যার পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে যেকোন সময় পুরো বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা যায়, আগামী ১২ই সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেওয়া হলেও বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ২৪টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩৩০০ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ক্লাস করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার পানিতে যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিমজ্জিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেযোগ্য হলো-১৮০ নং মজিদ সরকারের কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩১ নং জানাজাত কাঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫৬ নং খাসচর বাচামারা আজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৪ নং মাগুরখন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১১৮ নং রাজারচর পল্লী মঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
শিবচর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বন্যার কারণে উপজেলার চরাঞ্চলের চারটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চরজানাজাত ইউনিয়নে সাতটি, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে দুটি, বন্দরখোলায় পাঁচটি, সন্ন্যাসীর চরে একটি, মাদবর চরে একটি, বহেরাতলা দক্ষিণে তিনটি, নিলখীতে দুটি, দত্তপাড়ায় দুটি, শিরুয়াইলে একটিসহ মোট ২৪ বিদ্যালয় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
বন্দরখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়নের মালের হাট থেকে কাজির সূরা বাজার পর্যন্ত রাস্তাটি পানিতে ডুবে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী শিবচরের বন্দরখোলা, চরজানাজাত ও ফরিদরপুরের সদরপুর উপজেলার দিয়ার নারিকেল বাড়ি ও চর নাছিরপুর ইউনিয়নের লোকজনের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব এলাকার লোকজন বর্তমানে ট্রলার ও নৌকা দিয়ে চলাচল করছে। অন্যদিকে, কাজিরসূরা বাজারটি পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় ভাঙনের মুখ রয়েছে। বাজার ও আশপাশের লোকজন তাদের বাড়িঘর ও দোকানপাট সরিয়ে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।
বন্দরখোলার শাজাহান নামে এলাকার এক যুবক বলেন, ‘বন্দর খোলা ইউনিয়নের বেশিরভাগ বাড়িতে পানি উঠে গেছে। পরিবার ও গবাদি পশু নিয়ে খুবই বিপদের মধ্যে আছি। গতবছর কাজিরসূরা বাজারের কাছে একটি হাইস্কুল, একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক পদ্মায় তলিয়ে যায়। চলতি বছরেও মাছ বিক্রির টোল ঘরটির কিছু অংশ নদীতে ভেঙে গেছে।’
কাজিরসূরা এলাকার নাছিমা আক্তার বলেন, ‘গত ১০ বছরে এই এলাকার প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার এলাকা নদীতে তলিয়ে গেছে। প্রতিবছরই স্বাভাবিক পানি হলেই আমাগো এলাকায় বন্যা হয়ে যায়, বাড়িতে পানি উঠে যায়।’
মাদবরেরচর ইউনিয়নের পুরানকান্দিসহ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকায় শুধু পানি আর পানি। এসবএলাকার বসত-বাড়ির উঠান, রাস্তাঘাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে সড়কে আসতে নৌকা ও বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করতে হচ্ছে।
আলমাস হোসেন নামে স্থানীয় একজন বলেন, ‘আমাগো এলাকায় সব বাড়িতে পানি উঠে গেছে। নৌকায় করে বাড়ির মালামাল আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি রেখে আসছি। আমার বাড়িটি চরের মধ্য একটু উঁচু। পানি আর ৪/৫ ইঞ্চি বাড়লেই ঘরের মধ্য চলে যাবে। আর তাছাড়া সাপ, বিচ্ছুর উপদ্রব তো আছেই। নাতি-নাতনিসহ খুব আতঙ্কে আছি।’
বহেরাতলা দক্ষিণ ইউনিয়নের কলাতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েকদিনে এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও ২০ বিঘা ফসলি জমি আড়িয়াল খাঁ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনের মাধ্যমে সব সময়ই বন্যা দুর্গতদের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, শিবচরের সন্ন্যাসিরচর, বহেরাতলা দক্ষিণ, বন্দরখোলা ও শিরুয়াই এলাকায় নদী ভাঙন রোধে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
এ কে এম নাসিরুল হক/ এফআরএম/এএসএম