১৮ বছর ধরে বৈঠা বাইছেন চপলা মাঝি
অডিও শুনুন
‘আর কতকাল ভাসব আমি দুঃখের সারি গাইয়া
জনম গেল ঘাটে ঘাটে ভাঙ্গা তরী বাইয়া।’
এই গানের মতোই পুরো জীবন যেন খেয়া ঘাটেই কাটলো ৫৫ বছর বয়সী চপলা রাণীর। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর চার সন্তানসহ সংসারের হাল ধরতে তিনি নৌকার হাল ধরেছিলেন। টানা ১৮ বছর ধরে খেয়া পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন মানিকগঞ্জের চপলা রাণী।
এক সন্তানকে কাপড়ে বেঁধে, আরেকজনকে নৌকায় শুইয়ে শুরু হয়েছিল তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তবে জীবন যুদ্ধের এই সংগ্রামী নারীর এখন দিন কাটছে খুবই কষ্টে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা নতুন বাজার এলাকায় ইছামতি নদীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত খেয়া পারাপার করেন চপলা রাণী। বছর শেষে কয়েক মণ ধানের বিনিময়ে তার খেয়ায় পারাপার হন দু’পাড়ের মানুষ। এর বাইরে অন্যদের পার করে যা নগদ টাকা পান তা দিয়েই চলে সংসার।
চপলার স্বামী মৃত সুবাস চন্দ্র দাসও একই ঘাটে নৌকা বাইতেন। তাই সংসার চালাতে স্বামীর পেশা বেছে নিতে বাধ্য হন চপলা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নৌকায় যাত্রী পারাপারে ব্যস্ত চপলা রাণী। চোখে মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। তারপরও লগি ও বৈঠা দিয়ে তিনি নৌকা বাইছেন। কয়েকজন যাত্রীকে দেখা গেল পারের সময় বৈঠা চালিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে।
খেয়া ঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে চপলা রাণীর বাড়ি। বড় একটি বাঁশের সাঁকো পার হয়ে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একটি টিনের দো’চালা জরাজীর্ণ ঘরেই তার বসবাস। বাড়ির একমাত্র ঘর এটি। চাল দিয়ে বৃষ্টি পড়ায় কাঁচা মেঝে কর্দমাক্ত হয়ে আছে। এই ঘরটিও কয়েক বছর আগে একটি এনজিও করে দিয়েছিল। বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য হলেও টাকার অভাবে ঘর ঠিক করতে পারছেন না চপলা।
নৌকায় পার হওয়া স্কুলশিক্ষক শিলা আক্তারসহ কয়েকজন যাত্রী জানান, তারা প্রতিদিন চপলার খেয়া নৌকায় পারাপার হন। খুবই ভালো মানুষ তিনি। তার সংগ্রামী জীবন দেখে খুবই খারাপ লাগে। একজন নারী হয়ে অভাবের কারণে তাকে নৌকা বাইতে হচ্ছে। তার অভাব দূর করতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানান তারা।
খেয়া ঘাটের ব্যবসায়ী মো. রাজিব জানান, নদীর দুই পাড়েই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। একারণে নৌকায় এখন মানুষ পারাপার হয় কম। ফলে চপলা রাণীর রোজগার কমেছে। এ অবস্থায় কতদিন তিনি এই পেশা টিকিয়ে রাখতে পারবেন তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আফসার হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর চপলা তার স্বামীর পেশা বেছে নেন। এক শিশুকে কাপড়ে বেঁধে, অন্যজনকে শুইয়ে রেখে তিনি নৌকা চালিয়েছেন। নদীর পাড়ে টং ঘর তুলে সারারাত কাটিয়েছেন মানুষ পারাপারের জন্য। তার জীবনটা সত্যিই অনেক কষ্টের।
চপলা রাণী বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার আগে অনেক দিন অসুস্থ ছিল। তখন থেকেই নৌকা চালাই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতেই বাধ্য হয়ে স্বামীর পেশা বেছে নিয়েছি। কী করব বলেন? কষ্টের জীবন। এই কষ্ট থেকে কবে মুক্তি পাব জানি না। গত বছর বিধবা ভাতার কার্ড পাইছি।‘
তিনি বলেন, ‘চারপাশেই পাকা সড়ক হয়েছে। তাই মানুষ আর আগের মতো নৌকা পার হন না। টাকা পয়সার অভাবে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারিনি। একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বিবাহযোগ্য আরেকটি মেয়ে ঘরে। থাকার ঘরটি জরার্জীণ। কিন্তু মেরামত করার সামর্থ্য নেই। অনেক কষ্টে দিন কাটছে ।‘
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাওয়ার পর গত সপ্তাহে চপলা রাণীকে ঘর মেরামতের জন্য কিছু টিন দেয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে নতুন করে ঘর করে দেয়ার সুযোগ নেই।তবে বরাদ্দ পেলেই তাকে একটি ঘর করে দেয়া হবে।
এফএ/এমএস