কৃষকের ভিটে-জমি দখল করে ‘ফসল রক্ষা’র বাঁধ

জাহিদ খন্দকার জাহিদ খন্দকার
প্রকাশিত: ০৮:৪৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কৃষকের ভিটে ও ফসলি জমি দখল করে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ৫ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে। এক কোটি ৩২ লাখ টাকা অর্থায়নে এ বাঁধ নির্মাণকাজ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

কাজটি বাস্তবায়ন করছে ‘বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’। ভুক্তভোগীদের দাবি, স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজির মামলার ভয় দেখিয়ে সরকারি জায়গা ব্যবহার না করে নিম্নআয়ের কৃষকের ভিটেমাটি ও ফসলি জমির ক্ষতি করে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে স্থানীয় সংসদ সদস্য জানিয়েছেন, কৃষকদের জমির ওপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এলজিইডির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, এলজিইডি ও জাইকার অর্থায়নে বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাটাখালী নদীর তীরে ম্যাপ অনুযায়ী সরকারি খাসজমি বা রাস্তার ওপর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।

গোবিন্দগঞ্জের বড়দহ সেতু থেকে সাঘাটার ত্রিমোহনী সেতু পর্যন্ত ৫ দশমিক ৩ কিলোমিটার এই বাঁধ নির্মাণ ও বাঁধের পাশে বৃক্ষরোপণসহ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ নির্মাণকাজ প্রায় শেষ দিকে। এ বাঁধ সুফল দেয়ার বদলে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয়দের। যে বাঁধ ফসল রক্ষার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই বাঁধ গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি।

jagonews24৫ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে

স্থানীয়দের অভিযোগ, গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর ছোট ভাই লিটন চৌধুরীর প্রভাব খাটিয়ে কৃষকের জমিতে বাঁধ তৈরি হচ্ছে।

এ বাঁধ নির্মাণ স্থগিত চেয়ে এবং নির্মাণকাজে অনিয়ম তদন্ত করতে গত ৫ আগস্ট গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ও এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুক সোনাইডাঙ্গা গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষক ময়েন উদ্দিন।

এছাড়া ৭ আগস্ট গোবিন্দগঞ্জ প্রেস ক্লাবে ও ১০ আগস্ট গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে দাবি তুলে ধরেন স্থানীয়রা।

jagonews24বাঁধ নির্মাণ স্থগিত চেয়ে এবং নির্মাণকাজে অনিয়ম তদন্ত করতে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ও এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে

কৃষক ময়েন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মতো যাদের জমির ওপর দিয়ে বাঁধ গেছে তাদের সমিতির সদস্য না করে মনগড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ভূমির নকশা পরিবর্তন করে সরকারি খাসজমি ব্যবহারের পবিবর্তে তালুক সোনাইডাঙ্গা মৌজার ২৮৩ খতিয়ানের ৬০৭, ৬১২, ১১১৭, ১১২১, ১১২৫ দাগের আমার বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে মাটি নিয়ে আমার জমির ওপর দিয়েই ৪০ ফুট গোড়ালিসহ ১২ ফুট চওড়া মুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।’

এ গ্রামের মনি বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ক্ষমতা নেই, তাই আমাদের জমি জবরদখল করে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। বাধা দিতে গেলে এমপির ভয় দেখানো হয়। চাঁদাবাজির মামলার ভয় দেখানো হয়।’

jagonews24বাঁধ সুফল দেয়ার বদলে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয়দের

‘আমরা বিচার কার কাছে চাইবো? সরকারের কি টাকার অভাব যে আমাদের মতো নিম্নআয়ের কৃষকদের জমি দখল করবে? বাঁধ নির্মাণ কমিটি সন্ত্রাসী কায়দায় প্রভাব খাটিয়ে এই গ্রামের অসহায় মানুষদের জমির ওপর বাঁধ নির্মাণ করছে। প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজির মামলা দেয়ার হুমকি দেয়। এজন্য আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না’—ক্ষোভ প্রকাশ করেন কৃষক আব্বাস উদ্দিন।

ছায়দার রহমান নামে এক কৃষকের প্রায় তিন বিঘা জমির ওপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এতে ৩০ লক্ষাধিক টাকার ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি আমাদের জমি দখল করে বাঁধ নির্মাণ করেছে। আমরা অসহায়, আমাদের কথা কেউ শোনে না। প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজির মামলার হুমকি দেয়, আমাদের ক্ষতি হলেও দেখার কেউ নেই।’

তালুক সোনাইডাঙ্গা গ্রামের পল্লীচিকিৎসক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই বাঁধের কারণে আমার পাঁচ বিঘা জমির ক্ষতি হয়েছে। বাঁধে কোনো স্লুইস গেট নেই, তাহলে পাশের জমির পানি বের হবে কীভাবে? এই বাঁধের ফলে গ্রামের অনেক কৃষকের প্রায় ৫০ বিঘা জমির বেশি ক্ষতি হয়েছে।’

jagonews24কৃষকের ফসলি জমি দখল করে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে

গ্রামের আতিকুর রহমান বিটলের বসতবাড়ি এক বিঘা জমির ওপর। এ জমিতে তিনি এক লাখ টাকা খরচ করে মাটি ভরাট করেছেন। আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমার এ জমি উঁচু হওয়ায় সরকারি জায়গার ওপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ না করে বসতবাড়ির জমির ওপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

অনেকবার বাধা দিয়েছি কোনো লাভ হয়নি। তারা মামলার ভয় দেখিয়ে আমার জমির ওপর দিয়েও বাঁধ নির্মাণ করেছে। অথচ এই বাঁধের মাত্র ২০-২৫ ফুট কাছেই সরকারি জায়গা। এ জায়গা ব্যবহার করলে কৃষকদের ফসলি জমির ক্ষতি হতো না। আমরা এর প্রতিকার চাই।’

এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নওসা মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বাঁধ নির্মাণে কৃষকদের কোনো ক্ষতিপূরণের অর্থ নেই। আমরা বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে এলজিইডি ও জাইকার অর্থায়নে বাঁধ নির্মাণ কাজ করছি।’

jagonews24সম্প্রতি গাইবান্ধা প্রেসক্লাবে ভুক্তভোগী কৃষকদের সংবাদ সম্মেলন

অভিযোগ অস্বীকার করেন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী এবং তার ভাই লিটন চৌধুরীও।

মনোয়ার হোসেন চৌধুরী মোবাইল ফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে কিছু দিন আগে শুনলাম। আমার ভাই কাজ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে এটা জানি। আমার নাম ব্যবহার করে অবৈধ কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।’

জানতে চাইলে গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জাহিদ খন্দকার/এইচএ/এমকেএইচ

আমার মতো যাদের জমির ওপর দিয়ে বাঁধ গেছে তাদের সমিতির সদস্য না করে মনগড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ভূমির নকশা পরিবর্তন করে সরকারি খাসজমি ব্যবহারের পবিবর্তে তালুক সোনাইডাঙ্গা মৌজার ২৮৩ খতিয়ানের ৬০৭, ৬১২, ১১১৭, ১১২১, ১১২৫ দাগের আমার বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে মাটি নিয়ে আমার জমির ওপর দিয়েই ৪০ ফুট গোড়ালিসহ ১২ ফুট চওড়া মুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে

আমরা বিচার কার কাছে চাইবো? সরকারের কি টাকার অভাব যে আমাদের মতো নিম্নআয়ের কৃষকদের জমি দখল করবে? বাঁধ নির্মাণ কমিটি সন্ত্রাসী কায়দায় প্রভাব খাটিয়ে এই গ্রামের অসহায় মানুষদের জমির ওপর বাঁধ নির্মাণ করছে। প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজির মামলা দেয়ার হুমকি দেয়। এজন্য আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না

এ বাঁধ নির্মাণে কৃষকদের কোনো ক্ষতিপূরণের অর্থ নেই। আমরা বড়দহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে এলজিইডি ও জাইকার অর্থায়নে বাঁধ নির্মাণের কাজ করছি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।