গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খাল ১৬৬০ জনের দখলে, ব্যাহত সেচ কার্যক্রম
দখলদারদের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। প্রায় প্রতিদিনই একের পর এক দখল হচ্ছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খালের জায়গা। সরকারি হিসাব মতে, শুধু কুষ্টিয়া জেলায়ই গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খালের দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৬৬০ জন। চার জেলা মিলিয়ে এ দখলদারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতার কারণে দিন দিন দখলদারদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এজন্য ভেস্তে যেতে বসেছে বৃহৎ এ সেচ প্রকল্প। দীর্ঘদিন ধরে চার জেলার কয়েক হাজার কৃষক তাদের কাঙিক্ষত সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সঙ্গে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নের জন্য ১৯৫৪ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প গৃহীত হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে সেচের এটাই দেশের প্রথম ও সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সেচ, নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ—এ ত্রিমুখী পরিকল্পনা নিয়েই এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৫৪ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হলেও প্রকল্পের মাধ্যমে সেচ সুবিধা প্রদান কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬২ সালে। শুরুতে প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্ষা মৌসুমে সম্পূরক সেচ প্রদান করা। পরবর্তীতে এ প্রকল্পের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমেও সেচ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার এক লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি এ প্রকল্পের আওতাধীন। বর্তমানে এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় রয়েছে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দুটি পাম্পের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা বছরে ১০ মাস ফসলি জমিতে সেচকাজের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, দখলদারদের কারণে এ প্রকল্পের আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত শুধু কুষ্টিয়া জেলায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের জায়গা দখলকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৬০ জনে।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে এ প্রকৌশলী বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৬ হাজার ৩৬৩ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে ৩০ হাজার ৭৬৭ হাজার জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। একইভাবে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২১ হাজার ৩৬২ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হাজার ২৯৪ হেক্টর জমি, ঝিনাইদহ জেলায় ২৯ হাজার ২৭ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হাজার ৩১৮ হেক্টর জমি এবং মাগুরা জেলায় ৮ হাজার ৮৬৪ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৫৯৪০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। চার জেলা মিলিয়ে দখলকারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দখলের কারণে অনেক জায়গায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের খাল অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। খালের জায়গা দখল করে সেখানে অনেকেই ধানচাষ করছেন। কেউ কেউ বিল্ডিং বানিয়ে দখল করে নিয়েছেন। অনেক স্থানে সরকারি এই খালের জায়গা অন্যের নামে রেকর্ডভুক্তও হয়ে গেছে।
ভেড়ামারা উপজেলার চাঁদগ্রাম চন্ডিপুর ডি-৭ বিকে খালের প্রায় ৫০ মিটার জায়গা প্রভাবশালী একটি মহল দখল করে সেখানে ধানচাষ করছে। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলমান বলে জানান কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন।
দখলদারদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন বলেন, কুষ্টিয়া জেলার ১ হাজার ৬৬০ জন দখলকারীর মধ্যে তারা মাত্র ৮২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অর্থাৎ উচ্ছেদ করতে পেরেছেন।
একবার দখল হয়ে গেলে নানা কারণে উচ্ছেদ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় উল্লেখ করে এই প্রকৌশলী জানান, করোনা মহামারির কারণে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশ কিছুদিন ধরে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ। নির্দেশনা পেলে আবারো তারা দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বৃত্তিপাড়া এলাকার কৃষক নওশের আলী জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে তারা গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। বেশিরভাগ স্থানেই খালের জায়গা দখল করে মানুষ ধানচাষ করছেন। অনেক জায়গায় এখন আর খালের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। খালের ধারে বসবাসরত মানুষ নিজেরাই জায়গায় জায়গায় খালের ওপর বাঁশ দিয়ে সাঁকো বানিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছেন। প্রকল্পের সেচ সুবিধা না পাওয়ার কারণে এসব অঞ্চলের কৃষকরা এখন মেশিন দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে জমিতে সেচ দিচ্ছেন।
আল-মামুন সাগর/এসআর/এমএস