পদ্মার পানি শোধন করে চাহিদা মেটাবে রাজশাহী ওয়াসা

ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপরে নির্ভরশীল রাজশাহী ওয়াসা। তবুও বেশ কয়েক মাস ধরে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ড থেকেই অভিযোগ, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা। অন্যদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা। শুধু তাই নয়, বিশাল জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটানো যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্থাটির। এমন উভয় সঙ্কট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনের পথ বেছে নিয়েছে রাজশাহী ওয়াসা।
রাজশাহী ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, নগরবাসীকে নিরাপদ-সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে চার হাজার ১৫০ কোটি টাকার ‘রাজশাহী ওয়াসা ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পদ্মার পানি বিশুদ্ধ করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে রাজশাহী মহানগরী ছাড়াও জেলার গোদাগাড়ী, কাটাখালী এবং নওহাটা পৌরসভায়। ফলে আয়রন ও কেমিক্যালমুক্ত নিরাপদ পানি পাবেন ওয়াসার লাখ লাখ গ্রাহক।
মূলত প্রতি বছর গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, রাজশাহী অঞ্চলের পানিতে আয়রন ও ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি, পানির লেয়ার ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে ধাবিত হওয়া ও ভূ-গর্ভস্থ পানির লেবেল ঠিক রেখে রাজশাহীবাসীকে সুপেয় ও নিরাপদ পানি প্রদানের লক্ষ্যে এ মেগা প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চের দিকে সার্বিক বিবেচনায় রাজশাহী ওয়াসা চীনের হিউম্যান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ‘রাজশাহী মহানগরীতে ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার নির্মাণ’ শীর্ষক চার বছর মেয়াদি একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাকির হোসেন। তিনি জানান, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদিত হয়। পরে একনেকেও প্রকল্পটি পাস হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রাজশাহীর পানির সমস্যা আর থাকবে না। পাশাপাশি ভূ-উপরস্থ পানি শোধন করে পানযোগ্য করে তোলার কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপরেও চাপ কমবে।
মেগা প্রকল্পের চুক্তির বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রকল্প বাবদ চীন সরকারের থেকে প্রাপ্ত ঋণ রাজশাহী ওয়াসাকে পানি অভিকর বাবদ প্রাপ্ত আয় থেকেই পরিশোধ করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শতভাগ ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস (উৎস পদ্মা নদী) ব্যবহার করা হবে। এতে মহানগরবাসীসহ পার্শ্ববর্তী পৌরসভাগুলোর জন্যও আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজমুক্ত নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকার জন্য ২০১০ সালের ১ আগস্ট ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছরের ১০ মার্চ থেকে রাজশাহী ওয়াসা কার্যক্রম চালু করে। তখন নগরীর ৩০ ওয়ার্ডের ১০৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৫৬টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে আসছিল রাজশাহী ওয়াসা।
বর্তমানে ওয়াসা জনসংখ্যাভিত্তিক পানির প্রাপ্যতা (কাভারেজ) ৫২ শতাংশ থেকে ৮৪ শতাংশে উন্নীত করেছে। পানির সরবরাহ বৃদ্ধিতে পানি উৎপাদক নলকূপের সংখ্যা ৫৬টি থেকে ১১০টি করা হয়েছে। সঙ্গে পানির পাইপ লাইন ৫৫০ কিলোমিটার থেকে ৭১২ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ১৩ দশমিক ৫ কোটি লিটার পানি চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ৯ দশমিক ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে। উৎপাদিত পানির ৯০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি।
ওয়াসা সূত্র বলছে, রাজশাহী ওয়াসার পানি অভিকর সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন, ঢাকা ওয়াসাতে যা প্রায় ৭-১০ গুণ বেশি। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পানি উৎপাদন বাবদ বাৎসরিক বিদ্যুৎ ব্যয় মেটানোও সম্ভব হয় না। ফলে, নগরবাসীর জন্য নিরাপদ, বিশুদ্ধ ও টেকসই পানি সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে পানি অভিকর বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, নগরবাসীকে সুপেয় ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ‘রাজশাহী ওয়াসা’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ঢাকা ওয়াসা, খুলনা ওয়াসা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির অভিকরের তুলনায় রাজশাহী ওয়াসার পানি অভিকর অনেক কম। রাজশাহী ওয়াসার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অন্যান্য ওয়াসার পানি অভিকরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজশাহী ওয়াসার পানি অভিকর বৃদ্ধি করা সমীচীন।
সূত্রটি আরও জানায়, ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের খসড়া সম্পন্ন করা হয়। পরের বছর চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে এ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। অবশেষে চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে এ পানি শোধনাগার নির্মাণ করবে রাজশাহী ওয়াসা। সেটি স্থাপন করা হবে রাজশাহী নগরী থেকে প্রায় ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলার সারেংপুরে। সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি এনে নগরী ও এর আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করা হবে।
রাজশাহী ওয়াসার এমডি জাকির হোসেন জানান, প্রকল্পের টাকা দিয়ে শোধনাগার স্থাপন ছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণ এবং নতুন পাইপলাইন বসানো হবে। পুরনো পাইপলাইনগুলোও নতুন করে স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হতে সময় লাগবে প্রায় চার বছর। এরপর নগরীতে আর পানির কোনো সঙ্কট থাকবে না।
ফয়সাল আহমেদ/এসআর/এমকেএইচ