ঢাকাফেরত গরু নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ
>> ঢাকায় আনা-নেয়া ও হাটের ভিড়ের কারণে অসুস্থ হচ্ছে গরু
>> কেনা দামের কমেও মিলছে না ক্রেতা
>> খাবার, পরিচর্যা ও চিকিৎসা ব্যয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে
কোরবানি উপলক্ষে বেশি দামের আশায় রাজধানীর বিভিন্ন হাটে গরু তুললেও বিক্রি করেতে না পারায় ফেরত নিয়েছেন ব্যবসায়ী-খামারিরা। ঢাকাফেরত এসব গরু এলাকায় নেয়ার পর বিভিন্ন রোগে আক্রন্ত হচ্ছে। অনেকে কসাইয়ের কাছেই ওজন দরে অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে ব্যবাসায়ী-খামারিদের।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলার খামারি এবং ব্যবসায়ীরা কোরবানি সামনে রেখে ক্রস জাতের অস্ট্রেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ান ব্রিড, পাকিস্তানি সাহিয়াল ব্রিড ও দেশি জাতের গরু পালন করেন। কিন্তু এবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় গরুর দাম কম। ফলে এ অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী-খামারি মূলধন হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গবাদিপশুসমৃদ্ধ পাবনা অঞ্চলের খামারিরা জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোরবানির পশু দেশের বিভিন্ন হাটে সরবরাহ করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা খামারি ও চাষীদের বাড়ি থেকে নগদ ও বাকিতে গরু কিনে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন হাটে নিয়ে যায়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি ও করোনার কারণে গরুর দাম এবার তুলনামূলক কম ছিল। এতে ব্যবসায়ী ও খামারিরা লোকসানে গরু বিক্রিতে বাধ্য হন। আবার অনেকেই বিক্রি করতে না পেরে গরু ফেরত আনেন।
একাধিক ব্যবসায়ী ও খামারি জানান, চাহিদার চেয়ে হাটে সরবরাহ বেশি থাকায় ঈদের দুদিন আগে গরুর দাম কমে যায়। ফলে ট্রাক ও নৌকা ভাড়াসহ পথ খরচ উঠাতে লোকসানে গরু বিক্রি করতে হয়েছে। পাবনার পাঁচ শতাধিক গরু ব্যবসায়ী ও খামারি প্রত্যেকের ৫০ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আবু সাঈদ কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ও বাকিতে ৩৩টি গরু কিনেছিলেন। ঈদের তিনদিন আগে গরু তুলেছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি হাটে। লোকসানে ১৩টি গরু বিক্রি করতে পারলেও বাকি ২০টি অবিক্রীত রয়ে যায়। অবশেষে ঈদের দিন রাতে দ্বিগুণ ট্রাক ভাড়ায় গরু বাড়ি ফেরত আনি। ঢাকায় আসা-যাওয়া ও হাটের ভিড়ে গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনিতেই লোকসান ও ঋণের বোঝা, তার ওপর অসুস্থ গরুর চিকিৎসা ও খাওয়া খরচের চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা।
তিনি আরও বলেন, ‘গরুর ব্যবসা করব্যার যায়া শেষ অয়া গ্যাছি। কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা লোকসান হয়া যাতেছে। এ অবস্থায় ধারদেনা শোধ করার কোনো উপায়ই দেখতেছি না। ফেরত আনা গরুর পেছনে চিকিৎসা ও খাবার বাবদ প্রতিদিন ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।’
বেড়া পৌর এলাকার শম্ভুপুর মহল্লার গরু ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা হাটে ৪৯টি গরু নিয়ে গিয়েছিলাম। লোকসানে ৩০টি গরু বেচতে পারলেও বাকি ১৯টি নৌকায় ফেরত আনা হয়েছে। যাওয়ার সময় নৌকায় প্রতিটি গরুর ভাড়া এক হাজার টাকা করে নিলেও আসার সময় ভাড়া দিতে হয়েছে সাড়ে চার হাজার করে। সব মিলিয়ে আমার প্রায় ১৬ লাখ টাকা লোকসান।’
আতাইকুলা থানার চরপাড়া গ্রামের রোস্তম আলী বলেন, ‘ছয়টা গরু ঢাকায় নিয়েছিলাম। তিনটা ফেরত এসেছে। একই গ্রামের মফিজ মণ্ডল চারটা গরু ঢাকায় নিলেও সবকটিই ফেরত আনতে হয়েছে। তারই প্রতিবেশী সিরাজুল ইসলাম নিয়েছিলেন আটটি। তারও সবগুলো গরুই ফেরত আনতে হয়েছে।’
তারা জানান, কেনার অর্ধেক দাম উঠেছিল। এর সঙ্গে হাটে নেয়ার খরচ, গোখাদ্য, নিজেদের খরচ, রাখালদের মজুরি ও খাওয়া খরচ তো রয়েছেই। গরুফেরত আনতে আরও খরচ হয়েছে।
শুধু গরু ব্যবসায়ীরাই নন, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক খামারি স্থানীয় হাটে দাম না পেয়ে লাভের আশায় ঢাকায় নিয়েছিলেন। তারাও লোকসানে কিছু গরু বিক্রি করলেও বাকিগুলো ফেরত এনেছেন। ঢাকায় গরু আনা-নেয়া ও থাকার খরচ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়েছে।
ঈশ্বরদীর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার সাত ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা থেকে মৌসুমি ও স্থায়ী মিলে ২০০ ব্যবসায়ী রয়েছেন। খামারিরা জানান, মালিক ও ব্যবসায়ীরা ছোটবড় অন্তত ৬০০-৮০০ গরু ঢাকার বিভিন্ন হাটে নিয়ে যায়। অবিক্রীত হিসেবে ঈশ্বরদীতে ফেরত এসেছে প্রায় সাড়ে ৩০০ গরু।
খামারি ও ব্যাপারীরা জানান, গরু বিক্রি না হওয়ায় শুধু ঈশ্বরদীর ব্যাপারী আর খামার মালিকরাই প্রায় কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন। লোকসান ঠেকাতে স্থানীয় কসাইদের কাছে কম দামে বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যাপারীরা জানান, ভারত থেকে না আসায় এবার গরুর ভালো দাম পাওয়ার আশা ছিল। প্রথম প্রথম হাটগুলোতে দাম কিছুটা ভালো থাকলেও ঈদের দু-একদিন আগে থেকে দাম কমতে শুরু করে। ছোট বা মাঝারি সাইজের গরু মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি হলেও ৭০ হাজার বা এর চেয়ে বেশি দামের গরু কাঙ্ক্ষিত দাম মেলেনি।
এদিকে প্রতিষ্ঠিত গরুর ব্যাপারীরা জানান, কিছু ভুঁইফোড় ব্যাপারীর কারণেই গরুর ব্যবসা এমন হয়েছে। ঢাকাফেরত গরুর পরিচর্যায় এখন বাড়তি লোক রাখতে হচ্ছে। গরুর খাবার কিনতে হচ্ছে, আবার অসুস্থতার কারণে গরু দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
শনিবার (২৪ জুলাই) বনগ্রামে গরুর হাটে দেখা যায়, বেশকিছু ব্যাপারী ঢাকাফেরত গরু এনেছেন। কিন্তু ক্রেতা নেই।
বেড়া উপজেলার এক ব্যাপারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২৬টি গরু নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম। ২০টিই ফেরত এনেছি। যে ছয়টি বিক্রি করেছি তা ঢাকায় যাওয়া-আসা ও গোখাদ্য বাবদ খরচ হয়েছে। এখন পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে রয়েছি।
এদিকে পাবনার কাশীনাথপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র মাংস প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র বেঙ্গল মিট-এ ব্যাপারীরা গরু বিক্রির জন্য যাচ্ছেন। বেঙ্গল মিট’র ম্যানেজার (ক্রয়) শামীম আহমেদ জানান, ঢাকা থেকে ফেরত আনা গরু বিক্রির জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানে ব্যাপারীরা আসছেন।
বেঙ্গল মিট’র এজিএম মাসুমুল হক জানান, তারা রোগাক্রান্ত গরু কেনেন না। যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমেই কেনা হচ্ছে। ব্যাপারীরা জানান, বেঙ্গল মিট ওজন দরে গরু কিনছে। কোরবানির গরু ওজন দরে বেচতে গেলে অর্ধেক টাকাও ওঠে না।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মণ্ডল জানান, ঢাকা থেকে গরু ফেরত এসেছে। এর অর্থ দেশে চাহিদার তুলনায় গরু বেড়েছে। বাজার কম-বেশি হওয়ার নানা কারণ থাকতে পারে। দেশে গরুর চাহিদা মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না, এটা প্রমাণিত। ঢাকায় চাহিদার তুলনায় গরু বেশি যাওয়ায় এমন হয়েছে বলে তিনি জানান।
আমিন ইসলাম জুয়েল/এএইচ/এমএস