লাঠি হাতে মহাসড়কে পশুবাহী গাড়ি থামিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি
শনিবার দিনগত রাত ৩টা। বগুড়া শহরতলীর শাকপালা, বনানী ও লিচুতলা মোড়। সব পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ৭-৮ জন করে যুবক। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। নজর মহাসড়কে চলাচল করা গাড়ির হেডলাইটের দিকে। দূর থেকেই তারা বোঝার চেষ্টা করছেন কোনটি গরুবোঝাই ট্রাক আর কোনটি সাধারণ মালবাহী।
গরুবোঝাই ট্রাক কিছুটা কাছাকাছি এলেই সড়কের মাঝে ছুটে যান তারা। সিগন্যাল দিয়ে সড়কের একপাশে দাঁড় করিয়ে জোর করে আদায় করা হয় চাঁদা। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা না দিলে ট্রাক আটকে রাখার দেয়া হয় হুমকি-ধামকি।
রোববার (১৮ জুলাই) কথা হয় ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে।বগুড়ার বনানী মোড় থেকে ৫০০ গজ সামনে সোনার বাংলা হোটেলে খেতে নেমেছেন তারা। সেখানে খেতে বসে কীভাবে পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হলেন তার বর্ণনা করছিলেন ট্রাকচালক আমির হোসেন। তার বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে।
তিনি নিজের ট্রাকে এর আগে কখনো এই সড়কে গরু বহন করেননি। এ কারণে এভাবে চাঁদা দেয়ার ঘটনাটিও তার জন্য নতুন। আমির হোসেন বললেন, যারা চাঁদা তুলছে, তাদের মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া কিংবা লুকোচুরি নেই। প্রকাশ্যেই তারা চাঁদার টাকা নিচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলের মহাসড়কজুড়ে কোরবানির ঈদের আগে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। বাস, ট্রাকসহ যেকোনো যানবাহন আটকে আদায় করা হচ্ছে টাকা।
তবে মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা তোলা হলেও তা অস্বীকার করেছেন সংগঠন দু’টির নেতারা।
তারা বলছেন, যারা চাঁদা তুলছে এরা শ্রমিক নয়, শুধুই চাঁদাবাজ। অন্যদিকে চাঁদাবাজরা বলছে, তারা শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়োগ করা লোক।
সরেজমিন দেখা গেছে, চাঁদাবাজরা মহাসড়কে রীতিমতো ব্যারিকেড দিয়ে পণ্য ও গরুবাহী ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে। সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। শুধু বগুড়া জেলার ১৫টি পয়েন্টে তোলা হচ্ছে চাঁদার টাকা। তবে দিনের বেলা চাঁদাবাজরা সতর্ক থাকলেও রাতে হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া।
আন্তঃজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, ‘এই মুহূর্তে সাংগঠনিকভাবে সব ধরনের চাঁদা আদায় বন্ধ আছে। সড়কে কারা চাঁদা তুলছে তা আমি বলতে পারব না। তবে মোটর শ্রমিকের কিছু স্বেচ্ছাসেবী মহাসড়কে যানজট নিরসনে কাজ করছে বলে শুনেছি।’ তিনি দাবি করেন, ‘ট্রাক শ্রমিক পরিচয়ে কেউ চাঁদা আদায় করে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, বগুড়ার দু’টি বাইপাস মহাসড়ক ও মূল শহরের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১২০০ ট্রাক যাতায়াত করে। এগুলোর বেশির ভাগই বাইরের জেলার। মূলত চাঁদাবাজদের টার্গেটও বাইরের জেলার ট্রাক। কারণ এসব ট্রাকের চালকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ইচ্ছামতো চাঁদা আদায় করা যায়।
হাইওয়ে পুলিশের শেরপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বানিউল আনাম জানান, মহাসড়কে পণ্য কিংবা গরুবাহী ট্রাক থামানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মহাসড়কে কারা চাঁদা তুলছে, সেটি তারা তদন্ত করবেন। প্রয়োজনে গ্রেফতর করে মামলা দেয়া হবে।
টাঙ্গাইল এলাকার বাসিন্দা ট্রাকচালক আফতাব হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মাটিডালি দ্বিতীয় বাইপাস সড়কের মানিকচক এলাকায় ও বনানী লিচুতলা এলাকায় তাকে দুই দফায় ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।
একই রকম অভিযোগ করেন সিরাজগঞ্জের ট্রাকচালক সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের দাবি করা ৫০০ টাকা না দেয়ায় গাড়িসহ এক ঘণ্টা তাকে লিচুতলা মোড়ে হোটেলগুলোর সামনে আটকে রাখা হয়েছিল। এরপর ৪০০ টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।
ট্রাকচালকদের তথ্যমতে, চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বগুড়ার মোকামতলা, মহাস্থানগড়, মাটিডালির মোড়, চারমাথা বাসস্ট্যান্ড, তিনমাথা রেলগেট, শাকপালা, বনানী, লিচুতলা, শাহজাহানপুর, শেরপুর, মীর্জাপুর, ধুনট মোড়, মানিকচক, সাবগ্রাম ও চান্দাইকোনায়। এসব স্থানে নিজ জেলার গাড়ি থেকে আদায় করা হয় ৫০-১০০ টাকা। আর বাইরের জেলার গাড়ি থেকে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত।
জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান আকন্দ জানান, তারা মহাসড়কে চাঁদা আদায়ের পুরোপুরি বিপক্ষে। এরপরও কারা কীভাবে চাঁদা তুলছে, সেটি বুঝতে পারছেন না বলেও জানান তিনি। তবে চাঁদা তোলার তথ্য তার কাছেও রয়েছে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের যেকোনো পদক্ষেপে ট্রাক মালিক সমিতির সমর্থন আছে।
বগুড়ার শাকপালা এলাকায় ট্রাক ড্রাইভার খলিল মুন্সি জানান, তিনি যশোর থেকে বগুড়ায় ভাড়ায় মাল এনেছেন। বগুড়ায় মেডিকেলের পাশে বাবা কামালিয়া হোটেলের পাশে তার কাছ থেকে শ্রমিক নামধারী কিছু সন্ত্রাসী জোরপূর্বক ৫০০ টাকা চাঁদা নিয়েছে। লাঠি বের করে ভয় দেখালে বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েছেন তিনি।
বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ‘কোথাও চাঁদা উঠানো হচ্ছে না। যারা চাঁদা তুলবে, তাদের গ্রেফতার করা হবে।’ এসপি জানান, গরুর ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করার কোনো তথ্য তার জানা নেই। তাদের টহল পুলিশ প্রতিনিয়ত মহাসড়কে কাজ করছে। গোয়েন্দা পুলিশও মাঠে রয়েছে।
এএএইচ