ফরিদপুরে ইউনিয়ন সচিবের বিরুদ্ধে জন্ম সনদ জালসহ নানা অভিযোগ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফরিদপুর
প্রকাশিত: ১০:৫০ পিএম, ০৩ জুলাই ২০২১

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোহাম্মদ রিবুল হোসেনের বিরুদ্ধে জন্ম সনদ জাল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জন্ম নিবন্ধন সনদ পাল্টে যাওয়ায় বিপদে পড়া পরমেশ্বরদী গ্রামের ৩৫ ব্যক্তি এর প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এছাড়াও ইউপি সচিব রিবুল হোসেনের বিরুদ্ধে জন্ম নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সরকারি কাজে জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

তবে এসব অভিযোগ সত্যি নয় বলে দাবি করেছেন সচিব।

খোঁজ জানা যায়, ওই ইউনিয়নের ৩৫ নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন সনদে নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সবগুলো সনদেই রয়েছে পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোহাম্মদ রিবুল হোসেনের সই।

শ্রীনগর গ্রামের সচিন্ত্য কুমার খাঁয়ের ছেলে সত্যব্রত খাঁ। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার জন্ম নিবন্ধন করান। পরবর্তীতে একটি কাজের জন্য খোঁজ নিয়ে দেখেন তার জন্ম নিবন্ধনটি অনলাইন সার্ভারে নেই। অনলাইনে তার নিবন্ধন নম্বর দিয়ে জন্ম সনদ সার্চ করলে সত্যব্রত খাঁয়ের পরিবর্তে একই ইউনিয়নের ময়েনদিয়া গ্রামের জাকির শেখের ছেলে তামিনের নাম দেখা যায়।

একই ঘটনা ঘটেছে ওই গ্রামের মধুসুদন সাহার ছেলে সৃজন সাহার ক্ষেত্রে। তার পরিবর্তে ধুলজোড়া গ্রামের ছবির শেখের ছেলে আব্দুল্লাহ সিয়ামের নাম, প্রতাপ কুমারের ছেলে প্রত্যয় কুমার সাহার পরিবর্তে এসেছে ধুলুজোড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর মোল্যার ছেলে আ. আহাদ মোল্যার নাম। একইভাবে পরমেশ্বরদী গ্রামের দিপায়ন সাহার মেয়ে দয়িতা সাহার স্থলে মো. জিন্নাত মোল্যার মেয়ে মারজিয়া ইসলাম, পুতন্ত্রীপাড়া গ্রামের দূর্লভ চন্দ্র সাহার মেয়ে বাবলী রানী সাহার পরিবর্তে দেব কুমার মন্ডলের ছেলে দীপু মন্ডলের নাম রয়েছে সার্ভারে।

জন্ম সনদে নাম ঠিক না থাকায় বিপাকে পড়া বোয়ালমারী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিযোগ করে জানান, তার ছেলের পাসপোর্ট রয়েছে এবং বেতনের জন্য ইলেক্ট্রিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) কাগজপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে দেখেন অনলাইনে ছেলের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই। এ বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গেলে সচিব উল্টাপাল্টা কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওই সচিব তাকে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। বাড়াবাড়ি করলে সচিব তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকিও দেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক জাগো নিউজকে জানান।

শাহ্ জাফর টেকনিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপকও ইএফটি করতে গিয়ে বিপদে পড়েন অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকায়। পরবর্তীতে খোঁজাখুজি করতে গিয়ে দেখা যায়, আরও অনেকেরই জন্ম নিবন্ধন সনদ অনলাইন সার্ভারে নেই। তখন তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কারণ ইএফটি করতে না পারলে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের জন্য কোনো কাজ করতে পারবেন না।

দৌড়ঝাঁপে কাজ না হওয়ায় শ্রীনগর গ্রামের ৩৫ ব্যক্তি জটিলতা নিরসনের জন্য বোয়ালমারীর ইউএনও বরাবর লিখিত আবেদন করেন। এরপর ইউএনও ওই সচিবকে অফিসে ডেকে ভুক্তভোগীদের জন্ম নিবন্ধন সনদ ঠিক করে দিতে মৌখিক নির্দেশ দেন। এরপর সচিব পর্যায়ক্রমে ভুক্তভোগীদের সমস্যার সমাধান করছেন বলে জানা গেছে।

ভুক্তভোগী পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের বাসিন্দা ময়েনদিয়া বাজারের ব্যবসায়ী দুর্লভ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবেদন করার পাশাপাশি আমার এক আত্মীয়ও সচিব, তাকে দিয়ে ফোন করিয়ে জন্ম নিবন্ধন ঠিক করে নিয়েছি। তবে এখনও সবারটা ঠিক হয়নি। আমাদেরটা ঠিক করার সময় টাকা-পয়সা লাগেনি কিন্তু অন্য যারা এ কাজে গিয়েছেন তাদের কাজ টাকা ছাড়া হয়নি।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত সচিব মোহাম্মদ রিবুল হোসেন জন্ম সনদ জালিয়াতি ও অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আগে জন্ম নিবন্ধনের কাজ উদ্যোক্তারা করত। তারা কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে পারেনি। আমি বিপদে পড়া ব্যক্তিদের উপকার করেছি। নিজে কষ্ট করে তাদের জন্ম সনদ ঠিক করে দিয়েছি। উল্টো তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবে আগে জানলে তাদের কাজ করে দিতাম না।’

এক ব্যবসায়ীকে হুমকি দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রিবুল বলেন, ‘ওর হাত-পা ভেঙে দিয়ে আসতাম।’

ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে ওই শিক্ষকের চ্যালেঞ্জ হয়েছিল হয় আমি সৌদি চলে যাবো আর না হয় তাকে ভারত পাঠিয়ে দেব।’

জন্ম নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়টি সঠিক না বলে তিনি দাবি করেন।

এ বিষয়ে পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল আলম মিনা বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে কিছু অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। সচিবের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কথাও কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছেন। তবে এসব বিষয়ে আমি সচিবকে সতর্ক করেছি।’

পাল্টে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদে আপনার সই আছে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। বিশেষ করে সচিব এ কাজগুলো যাচাই-বাছাই করে সমাধান করে সই করেন। সচিবের সই দেখে আমিও নিজেও সই করেছি।’

বোয়ালমারীর ইউএনও ঝোটন চন্দ বলেন, ‘অভিযুক্ত ওই সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে মৌখিক আরও কিছু অভিযোগ আছে। নতুন করে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে সচিবের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আবেদনকারীদের জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়ার কাজটা তখন জরুরি ছিল। তাই সচিবকে ডেকে দ্রুত তাদের কাজ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।’

এন কে বি নয়ন/এসএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।