ঠাকুরগাঁওয়ে গৃহকর্মী নির্যাতন বাড়ছে
ঠাকুরগাঁওয়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের হার বাড়লেও এর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সংখ্যা কমছে বলে জানা গেছে। এর কারণ হিসেবে নির্যাতিতার অধিকার রক্ষায় আইন না থাকা এবং মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে পরিবারের অনীহার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার বেশিরভাগই নথিভুক্ত হয় না। তাদের অধিকার রক্ষায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রোটেকশন অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার পলিসি-২০১০ এর খসড়া তৈরি করেছিল। এরপর আর কাজ এগোয়নি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারা এখনও ওই খসড়ানীতি নিয়েই কাজ করছেন। ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবরের মধ্যে তারা এ নীতির বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের মতামত আশা করেছিলেন কিন্তু নীতিনির্ধারকরা কেউ তাদের মতামত জানাননি।
একটি এনজিও থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬১। কিন্তু মামলা হয়নি একটিও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে চার লাখ শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এদের মধ্যে এক লাখ ৩২ হাজার রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এতে বলা হয়েছে, কমবয়সী গৃহকর্মীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এদের সবার বয়স সাত থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
ঠাকুরগাঁও গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা এক মানবাধিকার কর্মী সুলতানা বলেন, গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় কোনো আইন বা পরিদর্শন ব্যবস্থাও নেই। কোনো নিবন্ধন বা পরিচয়পত্র না থাকায় এ পেশায় ঠিক কতজন কাজ করছে তার হিসাব আমরা বের করতে পারিনি। প্রচলিত শ্রম আইনে তাদের গণ্য করা হয় না বলে এসব শ্রমিক বিভিন্ন অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি হচ্ছে নির্যাতনের শিকার।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলাগুলো প্রাথমিক অবস্থাতেই মীমাংসা হয়ে যায়। মাত্র ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে হত্যা কিংবা অমানবিক নির্যাতনের ঘটনারও নিষ্পত্তি হয়। গৃহকর্মী নির্যাতন নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদ হলেও নির্যাতিত পরিবারগুলোর মধ্যে এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের প্রবণতা কমছে। এর পেছনে তিনটি রয়েছে। এগুলো হলো- এসব দরিদ্র পরিবার মামলা করলেও চালাতে পারে না, নির্যাতনকারী পরিবারের ভয়ভীতি আর দুই পরিবারের মধ্যে আর্থিক সমঝোতা।
তিনি বলেন, বাসা বাড়িতে শিশুকে ভারী কাজ করানোর অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করার বিধান রয়েছে। নির্যাতনের শিকার শিশু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর আওতায় বিচার চাইতে পারে। কিন্তু এ আইনে আসামিদের সাজা দেয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। এ আইনে কেবল দাহ্য পদার্থ দ্বারা পুড়ে গেলে সাজার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বেত্রাঘাত, গরম খুনতি, লোহা, ইস্ত্রির ছ্যাঁকা, গরম পানি ঢেলে দেয়া এ আইনের আওতায় পড়ে না।
পৌর শহরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহকর্মী বলেন, বাড়ির মালিক প্রায় আমাকে মারধর করে। আমার বাবা-মাকে বেশি টাকা দিয়ে রাখায় আমি এখান থেকে চলে যেতে পারি না।
ঠাকুরগাঁও শহরের হাজীপাড়া মহল্লায় জিয়া নার্গিস (১১) বলেন, আমাকে বিভিন্ন অযুহাতে মারধর করতো। এতে প্রতিবাদ করলে এর মাত্রা আরও বেড়ে যেতো। গত রোববার মাঝরাতে গৃহকত্রী মৌসুমী আক্তারের শিশু বাচ্চা বিছানায় প্রসাব করে। নার্গিস তা বুঝতে না পেরে ভেজা বিছানায় লেপ বিছিয়ে দেয়। এতে লেপ ভিজে যায়। না বুঝে ভুল করলেও এ অপরাধে বাড়ির গৃহকত্রী তাঁকে বেলনা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে।
গৃহকর্মী নার্গিসের মা মোসলেমা বেগম বলেন, অভাবের তাড়নায় মেয়েকে গৃহকর্মীর কাজ করতে দিয়েছে। আমার মেয়ে প্রায় অভিযোগ করতো মারধরের। কিন্তু বাড়ির মালিককে ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শাহাবুদ্দীন খাঁন লার্জ বলেন, বেশিরভাগ গৃহকর্মীর অপমৃত্যু মামলায় মেডিকেল রিপোর্টের ফলাফলে আসে আত্মহত্যা। যার ফলে পরবর্তী সময় মামলা আর এগিয়ে নেয়া যায় না। অর্থনৈতিকভাবে সক্ষমরা মেডিকেল রিপোর্ট নিজেদের পক্ষে আনার জন্য অর্থের ব্যবহার করে। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গৃহকর্মীরা প্রায় সময়ই সঠিক বিচার পায় না।
ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা মশিউর রহমান বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর পেলেই পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যায়। গত দুইদিন আগে আর্ট গ্যালারিতে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে টানা হেচড়া হলে পুলিশ গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কোনো গৃহকর্মীর উপর অমানবিক নির্যাতন হলে গৃহকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গৃহকর্মী নির্যাতন রোধে জেলা প্রশাসন থেকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন সভা সেমিনানের ব্যবস্থা করা হবে।
রবিউল এহসান রিপন/এসএস/এমএস