শীতলক্ষ্যার তীরে ভেঙে দেয়া হলো বিএনপির সাবেক এমপির কারখানা
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আটি এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ১৯ একর চরভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা বিএনপির সাবেক এমপি পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমের মালিকানাধীন আম্বর পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল গুড়িয়ে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দু’টি এক্সাভেটরের মাধ্যমে মিলটির দখলে থাকা একাধিক পাকা স্থাপনা, নির্মাণাধীন ভবনের স্থাপনা ও সহস্রাধিক ফুট দেয়াল এবং বসতঘর উচ্ছেদ করা হয়।
উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সিদ্ধিরগঞ্জ সার্কেলের অ্যাসিল্যান্ড শীলু রায়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (বন্দর) মাহবুবুল আলম, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন, উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা, সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম প্রমুখ।
এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি সরাফতউল্লাহর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল ওই স্থানে।
এদিকে উচ্ছেদ অভিযানের কারণে মিলটির মালিকপক্ষের অন্তত ৩০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান মিলের মহাব্যাবস্থাপক (অর্থ) মীর মোহাম্মদ নুরুন্নবী। তাদেরকে বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। তবে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছিল এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের আটি ও আজিবপুর মৌজায় জেলা প্রশাসন থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর চর লিজ নিয়ে ভরাট করে ১২ একর জমিতে আম্বর পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলটি গড়ে তোলেন বিএনপির সাবেক এমপি পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম। জেলা প্রশাসক ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিলেও পরে তা আবার বাতিলও করা হয়। এ নিয়ে আম্বর পেপার মিল কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করে। যা বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল কোনো পক্ষই ওই জমিতে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবেনা। তবে আম্বর পেপার মিল মালিকপক্ষ হাইকোর্টের সেই নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে গত কয়েক বছর ধরেই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ কাজ চালিয়ে আসছিল। তারা শীতলক্ষ্যার সীমানা পিলার ভেঙে ফেলে তার উপরেই দেয়াল নির্মাণ করেছিল। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ মিলটির মালিকপক্ষকে একাধিকবার নোটিশ দিলেও তারা কোনো ধরনের কর্ণপাত করেনি। মিলটির মালিকপক্ষ নদীর সীমানা পিলারের উপর বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণের পর ভেতরে নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য কয়েকদিন পূর্বে পাইলিং করে কাজ শুরু করে। বিষয়টি জানতে পেরে গত বৃহস্পতিবার নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এমপি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। পরে আম্বর পেপার মিল মালিকপক্ষকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়। তবে মিলটির মালিকপক্ষ ৪৮ ঘণ্টা সময় নিলেও তারা অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শুক্রবার সকালে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক ওই এলাকাটি পরিদর্শনে এসে আবারো মিলটির মালিকপক্ষকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। তবে এরপরও মিলটির মালিকপক্ষ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ দু’টি এক্সাভেটর দ্বারা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে।
এসময় মিলটির দখলে থাকা দু’টি পাকা অবৈধ স্থাপনা, ওয়াকওয়ের পাশে স্থাপিত লোহার তারের ও টিনের বেড়া, নির্মাণাধীন ভবনের পাইলিং সামগ্রী ও সহস্রাধিক ফুট দেয়াল এবং শ্রমিকদের বসতঘর উচ্ছেদ করা হয়। মিলটির মালিকপক্ষের লোকজন উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিতে আসলেও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের সাহসকিতার কারণে দখলকারীরা পিছু হটে।
এদিকে উচ্ছেদ অভিযানের সময়ে এলাকাবাসী করতালির মাধ্যমে অভিযানকে সাধুবাদ জানান। কারণ ওই এলাকায় ইকোপার্ক ও মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় এমপি। অভিযানের পক্ষে বিপক্ষে নিয়ে দুই যুবকের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
মহাব্যাবস্থাপক (অর্থ) মীর মো. নুরুন্নবী জানান, তাদেরকে উচ্ছেদের পূর্বে মৌখিকভাবে জানানো হলেও লিখিত নোটিশ দেয়া হয়নি। তাদেরকে শনিবার পর্যন্ত সময় দেয়া হলেও এর আগেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা কেন অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করছিলেন এ প্রসঙ্গে নুরুন্নবী বলেন, আমরা ওই বিষয়টি নিয়ে সারেন্ডার করেছি। কিন্তু আমাদের পুরনো স্থাপনা অন্যায়ভাবে ভাঙা হয়েছে। আকস্মিকভাবে উচ্ছেদের কারণে তাদের আনুমানিক ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে একটি মেশিনের ডান্ডি রোল ভেঙে গেছে যার মূল্যই কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা।
বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন বলেন, মন্ত্রীর নির্দেশে এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আদালতে নির্দেশনা থাকার পরেও মিলটির মালিকপক্ষ অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছিল। শীতলক্ষ্যা নদীসহ ঢাকার চারপাশের ৪টি নদী রক্ষায় হাইকোর্টের নির্দেশে সীমানা পিলার স্থাপন করা হলেও সেই সীমানা পিলারই দখল করে নিয়েছিল আম্বর পেপার মিল। তারা সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিংও করছিল। শনিবার উচ্ছেদ অভিযানে মিলটির নতুন যেসকল স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল সেগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত জায়গা থেকে সমস্ত মালামাল ও যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিতে ৩ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এমপি। বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে মালামাল ও যন্ত্রপাতি না সরানো হলে ওইগুলো জব্দ করে নিলামে বিক্রি করা হবে।
হোসেন চিশতী সিপলু/এমএএস/আরআইপি