বোনের প্রতারণায় সর্বস্বান্ত বিধবা ফাতেমা ফিরে পেলেন সম্পত্তি
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা বিধবা ফাতেমা। নিঃসন্তান ফাতেমা অক্ষরজ্ঞানহীন। বড় বোন ছায়েদা তার কাছে কিনতে চেয়েছিলেন পাঁচ কাঠা জমি। কিন্তু সুকৌশলে পরিচিত এক দলিল লেখকের মাধ্যমে পাঁচ কাঠার বদলে লিখে নেন সব জমি। বড় বোনের প্রতারণায় সর্বস্বান্ত ফাতেমার মাথা গোঁজার জন্য এক খণ্ড জমিও ছিল না।
বোনের প্রতারণায় জমি হারানো ফাতেমা রাজশাহীর বাগমারার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। আদালত রায় দেন ফাতেমার পক্ষে। তাতেই হারানো সব জমি ফিরে পেয়েছেন ফাতেমা। রায়ে ভুয়া দলিল বাতিল করে ছায়েদা (বড় বোন) ও দলিললেখক আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফৌজদারি মামলা করেছেন।
রোববার (৬ জুন) সন্ধ্যায় বাদীর আইনজীবী মো. রেজাউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রাজশাহীর বাগমারা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৮১/২০১৬ (অপ্র) মামলায় আজ রোববার এই রায় ঘোষণা করা হয়।
আইনজীবী রেজাউল ইসলাম বলেন, বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের ফাতেমা একজন বিধবা, নিঃসন্তান ও অক্ষরজ্ঞানহীন নারী। তার কাছ থেকে ৫ কাঠা জমি কেনার কথা বলে বড় বোন ছায়েদা নতুন দলিল বানিয়ে ভিটেমাটিসহ ফাতেমার পুরো ৮ বিঘা সম্পত্তি নিজের নামের লিখে নেন। বিষয়টি জানার পর ফাতেমা বাগমারা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দলিল বাতিলের আবেদন জানিয়ে মামলা করেন।
তিনি বলেন, মামলায় প্রমাণ হয় ফাতেমার পক্ষে দলিল লেখার সময় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি দলিলের মর্মও ফাতেমাকে পড়ে শোনানো হয়নি। দলিললেখক, দলিলের সাক্ষী সবাই ছিল বড় বোন ছায়েদার পক্ষের। আদালতে আরো প্রমাণ হয়- সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের একটি চক্রের যোগসাজশে ছায়েদা এই দলিল করে নিয়েছিলেন। যেখানে তার ছেলে সাইদুর রহমান এবং দলিললেখক আব্দুল হাকিম এই জালিয়াতিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছায়েদার ছেলে সাইদুর রহমান আদালত পাড়ায় দলিললেখকের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। শুধু তাই নয়, দলিললেখক আব্দুল হাকিমের সঙ্গে তাদের রয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক। আব্দুল হাকিমের ভাই জাকিরুল ইসলামও দলিললেখকের সহযোগী, যাকে এই দলিলের সাক্ষী করেছেন আব্দুল হাকিম।
দলিললেখক আব্দুল হাকিমের স্ত্রীও সংশ্লিষ্ট ভবানীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নকলনবিশ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও তাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী জমি জালিয়াতির সিন্ডিকেট। তাদের সকলের সম্মিলিত যোগসাজশে দলিলটিতে ফাতেমার সমস্ত সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে প্রমাণিত হয় আদালতে।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, ৫ কাঠার কথা বলে দলিলে ৮ বিঘা সম্পত্তি তুলে নেয়া হলেও ছোট বোন ফাতেমাকে দলিল বাবদ কোনো মূল্যই পরিশোধ করেনি বড় বোন ছায়েদা। অন্যদিকে দলিল হলেও সম্পত্তির দখল পাননি বড় বোন ছায়েদা। পুরো সম্পত্তি এখন পর্যন্ত ফাতেমার দখলেই আছে বলে দেখা যায়, যা আদালতে প্রমাণিত।
তিনি আরো বলেন, রেজিস্ট্রেশন খরচ ফাঁকি দিতে দলিলটিকে হেবা দলিল হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হয়। দলিলে লেখা হয়, বড় বোন ছায়েদার সেবাযত্নে খুশি হয়ে ছোট বোন ফাতেমা সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন। কিন্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায়, সেবাযত্ন করার দাবি বানোয়াট। সবমিলিয়ে বড় বোন ছায়েদা ও দলিললেখক আব্দুল হাকিমের সাক্ষ্যের কিছু অংশ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতারক ছায়েদা আদালতে দাবি করেন, দলিল লেখার সময় ছোট বোন ফাতেমার পক্ষে জনৈক মকবুল চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। একইভাবে দলিললেখক আব্দুল হাকিম দাবি করেন, তাকে দলিল লেখার খরচ ফাতেমা (দলিলদাতা) দিয়েছেন। কিন্তু বিচারে প্রমাণিত হয় যে, তাদের দু’জনই শপথ নিয়ে মিথ্যা বলেছেন।
বাদীর আইনজীবী মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, আদালত তার আদেশে দলিলটি বাতিল করেন এবং বাদীর মামলার খরচ পরিশোধে বিবাদীকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে বিবাদী ছায়েদা ও দলিললেখক আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
তিনি বলেন, জমির দলিল বাতিল আদেশের আইনটি খুব জটিল একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই চোখে পড়ে। রাজশাহীর বাগমারা সিনিয়র সহকারী জজ মারুফ আল্লাম যেই পদক্ষেপটি নিয়েছেন, সেটি অত্যন্ত সাহসের ও প্রশংসনীয়। এমন বিচারিক প্রথা চালু হলে হয়তো ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সেইসঙ্গে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা মামলার নিষ্পত্তি ঘটবে।
ফয়সাল আহমেদ/এএএইচ