ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুড়ছে ফসল, পচছে আম
>> এক ইউনিয়নে ১৯ ইটভাটা
>> ৩০০ একর জমির আম ও ধানসহ ৩০ প্রকার ফসল নষ্ট
>> ইউএনও বরাবর ৩ শতাধিক কৃষকের স্মারকলিপি
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের ইটভাটাগুলোর জন্য নিঃস্ব হয়েছেন পাঁচ শতাধিক কৃষক। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ধানসহ বিভিন্ন ফসল পুড়ে গেছে।
পরিপক্ব হওয়ার আগেই পচে ঝরে পড়ছে বাগানের আম। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন ফলও পচে ঝরে পড়ছে।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী তিন শতাধিক কৃষক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) স্মারকলিপি দেন। ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। ইটভাটার কারণে আম ও ফসলের ক্ষতির বিষয়টি মানতে নারাজ ভাটার মালিকরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ৯ নম্বর হামিদপুরের একটি ইউনিয়নেই ১৯টি ইটভাটা। যার বেশিরভাগই অবৈধ। দক্ষিণ পলাশবাড়ী ও বাঁশপুকুর মৌজার ছয়টি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ওই এলাকার ধান পুড়ে গেছে এবং বাড়ির চারপাশের আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য গাছের পাতা কুঁকড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ফলগুলো ঝরে পড়ছে। ৫০টি বাগানের আমের নিচের অংশ পচে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। বাগানের আমগুলো বর্তমানে বিক্রির অনুপযোগী।
ধুলাউদাল গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আজিজুর রহমান, মোজহারুল আলম, আবিদা খাতুন ও আমিনুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, ‘১৩ ও ১৫ মে ভোরে হামিদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশবাড়ী ও বাঁশপুকুর মৌজার এআরবি ব্রিকস, একে ব্রিকস, সোহাগী ব্রিকস, অর্ণব ব্রিকস, একতা ব্রিকস ও জহুরা ব্রিকসের বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দুই মৌজার ২০০ একর ধান ও ১০০ একর জমির ৫০টি আম, বাঁশ ও লিচু বাগান, কলা, নারিকেল, পেয়ারা, জলপাই, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের মাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে এলাকার প্রায় ২ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
কৃষকরা জানান, কোনো ফসল বাড়িতে তোলার মতো অবস্থায় নেই। এ এলাকার আমের গুটি এখন ঠিক মতো হয়নি। অথচ আমগুলো চোখের সামনে পচে পড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পথে বসে গেছি।
ক্ষতিগ্রস্তরা আরও বলেন, আমরা ইটভাটার কর্তৃপক্ষে সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করছে না। বাধ্য হয়ে আমরা ইউএনও বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি। গত বছরও আমাদের এই এলাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। এ বছর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। আগামীতে যেন এ ধরনের ক্ষতির মুখে না পড়ি সে ব্যাপারে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।
কাশেম আলী, রিয়াজুল মণ্ডল, শাহনাজ বেগমসহ শতাধিক কৃষকের অভিযোগ, পুরাতন পদ্ধতির (ফিস) ভাটা ব্যবহার করছেন মালিকরা। এ ভাটার গ্যাস দিয়ে আমাদের আম বাগানের আম, ধানসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ইউএনওর কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু ভাটার মালিকরা অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আমরা এর প্রতিকার চাই।
এ ব্যাপারে হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় এ এলাকার কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে। তারা আমার কাছে এসেছিল। আমি তাদের ইটভাটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বলেছি। আমাদের এই এলাকার অনেক কৃষকই বর্গাচাষি। তারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। এখন তাদের বেঁচে থাকার উপায় নেই।’
ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু বলেন, ‘দিনাজপুর কৃষিপ্রধান জেলা। অথচ এই জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নে এতগুলো ইটভাটা। এই ইটভাটাগুলোর অনুমোদন কে দিল? আমরা সরেজমিনে গিয়েছি, সেখানে কৃষকদের কান্না দেখে খুব খারাপ লেগেছে। এ এলাকার জমির ফসল শুধু ওই এলাকার লোকজনই খাবে না, পুরো দিনাজপুর ও বাইরের মানুষও খাবে। এটা পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।’
বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে একে ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমার ইটভাটা এখনো চালু আছে। আগামী এক মাস চলবে। ইটভাটা থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ধোঁয়া ছাড়া হয়নি। অথচ এলাকার লোকজন আমাকে দোষ দিচ্ছে।’
পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাশিদ কায়সার রিয়াদ বলেন, ‘হামিদপুর ইউনিয়নের ছয়টি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় বহু কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। রোববার তিন শতাধিক কৃষকের স্বাক্ষরসহ একটি স্মারকলিপি আমি পেয়েছি। অভিযুক্ত ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কৃষকের ‘জানালা তথ্য বাতায়নে’ গিয়ে দেখা যায়, বাতাসে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া মিশে কার্বন মনোক্সাইডের ঘনত্ব বেড়ে যায়। এতে আমের নিচের অংশ কালো এবং ভেতরের অংশ নরম হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
এর প্রতিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, রোবাক্স অথবা কস্টিক সোডা ছয় গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দু’বার স্প্রে করলে এ রোগ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
এসজে/এমএস