শিকার-পাচারে বিলুপ্তির পথে কচ্ছপ

সাইফ আমীন
সাইফ আমীন সাইফ আমীন , নিজস্ব প্রতিবেদক বরিশাল
প্রকাশিত: ১২:৪৫ এএম, ২৪ মে ২০২১
ছবি: সংগৃহীত

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে যেকোনো প্রজাতির কচ্ছপ ধরা, কেনা-বেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে কচ্ছপ ব্যবসায়ীদের কাছে এই আইন যেন কোনো বাধা নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে বরিশালের বিভিন্ন নদী-খাল-বিল-জলাশয়ে নির্বিচারে চলছে কচ্ছপ নিধন। ফলে কচ্ছপ এখন বিলুপ্তির পথে।

রোববার (২৩ মে) আন্তর্জাতিক কচ্ছপ দিবস উপলক্ষে বরিশালের ১০ উপজেলার ৩৫ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানান, আগৈলঝাড়া, বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জে কচ্ছপ কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে আগৈলঝাড়ার মোল্লাপাড়ায় সাহেবেরহাট ও উজিরপুরের হারতায় কচ্ছপ বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার। মোল্লাপাড়ায় সাহেবেরহাটে প্রকাশ্যে কচ্ছপ বিক্রি হয়। বানারীপাড়ার বিশরকান্দি হাটেও বেচা-কেনা হয় বিক্রি নিষিদ্ধ এ প্রাণী।

আগৈলঝাড়ার সাহেবেরহাট বাজার কমিটির এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, হাটে প্রতিদিনই দুই একজন কচ্ছপ আনেন। বৃহস্পতি ও সোমবার হাট হাটে কচ্ছপ বেশি আসে। এ দুই কচ্ছপ কিনতে দূর-দূরন্ত থেকে ক্রেতারাও আসেন। প্রতি হাটে ৩০-৪০ হাজার টাকার কচ্ছপ বিক্রি হয়।

jagonews24.com

সুভাষ (৫০) নামে সাহেবেরহাটের এক কচ্ছপ বিক্রেতা জানান, এসব কচ্ছপের বেশিরভাগ আশপাশের খাল-বিল জলাশয়ের।এছাড়া নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও পটুয়াখালী থেকেও শিকারিরা নিয়ে আসেন। আগৈলঝাড়ায় কচ্ছপের চাহিদা একটু বেশি। মিঠা পানির কচ্ছপ আকার ও প্রজাতি ভেদে প্রতিকেজি হাজার টাকা থেকে ১৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।

মনিন্দ্র নামের আরেক বিক্রেতা জানান, হাটে এক সময় বিশাল আকৃতির কচ্ছপ পাওয়া যেত।এখন আসে না।৭০০ গ্রাম থেকে এককেজি ওজনের কচ্ছপ বেশি বেচাকেনা হয়। দু একটা সোয়া কেজি ওজনের থাকে। জীবিত কচ্ছপই বেশি বিক্রি হয়। প্রজাতির মধ্যে সুন্ধি কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও গাঙ্গুয়া কাছিম বেশি পাওয়া যায়। আরও দুই এক প্রজাতির কচ্ছপ মাঝে মধ্যে হাটে ওঠে।বড় কচ্ছপের দাম ১২০০ টাকা এবং কেজির নিচের সাইজে বিক্রি হয় ৮০০ টাকা দরে।

হাটে আসা আরও কয়েকজন বিক্রেতা জানান, নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ে বড়শি, কোঁচ, কারেন্ট জালসহ নানা সরঞ্জাম দিয়ে শিকার করা হয় কচ্ছপ। শীতকালে কচ্ছপ বেশি পাওয়া যায়। কার্তিক থেকে চৈত্রমাস কচ্ছপ শিকারের মৌসুম। এ সময় প্রজনন মৌসুম হওয়ায় কচ্ছপ ডাঙায় ওঠে।ফলে বেশি ধরা পড়ে।

jagonews24.com

বিক্রেতারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা হাটে কচ্ছপ বিক্রি করলেও এখন পর্যন্ত কোনো বাধা পাননি।

তারা বলেন, সাহেবেরহাট ছাড়াও এ উপজেলার গৈলা বাজারের উত্তর দিকে রথখোলা বাজার ও উজিরপুর উপজেলার হারতা এবং কারফা বাজারের কয়েকটি মাছের আড়তে কচ্ছপ বিক্রি হয়।

হারতা বাজারের আকন্দ ফিস এন্টারপ্রাইজের মালিক ইউনুস আকন জানান, মাঝে মধ্যে গোপনে কিছু লোককে কচ্ছপ বিক্রি করে।তবে আইনগতভাবে নিষিদ্ধি হওয়ায় স্থানীয় কেউ কচ্ছপ বিক্রি করেন না। যারা বিক্রি করেন তারা বিভিন্ন জায়াগা থেকে আসেন।

বানারীপাড়ার বিশরকান্দি ইউনিয়নের এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, রোববার ও বুধবার বিশরকান্দিতে হাটে মাঝে মধ্যে কচ্ছপ বিক্রি হয়।

বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরিঘাট সংলগ্ন মাছ বাজারের এক বিক্রেতা জানান, আড়িয়াল খাঁ নদীতে জেলেরা মাছ শিকারের সময় মাঝে মধ্যে কচ্ছপ পায়।সেগুলো কেউ বিক্রির জন্য বাজারে আনেন। আবার কেউ পরিচিতদের বাড়ি দিয়ে আসেন।

হিজলা উপজেলার পলাশ চন্দ্র জানান, কয়েক বছর আগেও মেঘনার তীরবর্তী বিভিন্ন আড়ৎ বা হাট-বাজারে কচ্ছপ বিক্রি হতো।তবে এখন সেভাবে পাওয়া যায় না।কচ্ছপ বিক্রির ধর এখন বদলেছে।বিক্রেতারা ক্রেতাদের কাছে ফোন নম্বর দিয়ে রাখেন। প্রয়োজনে ফোন দিলেই পৌঁছে দেয়া হয়।

পলাশ চন্দ্র বলেন, মুলাদী ও মেহেন্দিগঞ্জেরকিছু স্থানে এ পদ্ধতিতে কচ্ছপ বেচাকেনা চলছে।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার একাধিক মানুষ জানান, উলানিয়া পাইকারী মাছ বাজারে অনেক আড়ৎ। কিছু আড়তে গোপনে কচ্ছপ বিক্রি হয়।

সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা প্রবীণ জেলে খোরশেদ আলী জানান, কদমতলি নদীতে বেশ কয়েকজন নৌকায় করে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন। ওই বড়শিতে অনেক সময় কচ্ছপ ধরা পড়ে।পরে তা বিক্রি করা হয়।

শায়েস্তাবাদ বাজারের এক মাছ বিক্রেতা জানান, ১৫ দিন আগে বাইল্লারচরের একজন ব্যক্তি বাজারে সাত কেজি ওজনের বড় একটি কাছিম এনেছিলেন। তিনি ওই কচ্ছপের দাম চেয়েছিলেন সাত হাজার টাকা। তবে গ্রামের বাজারে এত বেশি দামে কেনার কেউ ছিল না। পরে তিনি বরিশালের নতুন বাজারের সঞ্জয় দাস নামে এক মাছের আড়তদারের কাছে ছয় হাজার টাকায় সেটি বিক্রি করেছেন বলে শুনেছি।

jagonews24.com

নগরীর একাধিক বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর আগে নগরীর বড় বাজার, নতুন বাজার ও পোর্টরোড মাছের আড়তে কচ্ছপ বিক্রি হতো। তখন বিশাল আকারের কাছিম কেটে কেজি হিসেবে বিক্রি হতো। এখন পোর্টরোডে মাঝে মধ্যে ডাকের মাধ্যমে কচ্ছপ বিক্রি হয়। ডাকের মাধ্যমে ওই কচ্ছপ কিনেন মৎস্য শ্রমিকদের একটি চক্র। পরে তারা বেশি দামে বাইরে বিক্রি করেন।

নগরীর নতুন বাজারে দীর্ঘদিন ধরে কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে মাছ বিক্রির আড়ালে কচ্ছপ বিক্রি করে আসছেন সঞ্জয় দাস। তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে কচ্ছপ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে তার ব্যবসার নেটওয়ার্ক।টাকার বিনিময় অতি বিরল কচ্ছপও সংগ্রহ করে দিতে পারেন তিনি।

শুক্রবার (২১ মে) দুপুরে ক্রেতা পরিচয়ে সঞ্জয় দাসের মুঠোফোনে কল করা হয়। প্রথমে তিনি পরিচয় জানতে চান। তার পরিচিত মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নম্বর পেয়েছি জানালে তিনি ওই মাছ ব্যবসায়ীর নাম জানতে চান। মাছ ব্যবসায়ীর নাম জানালে তার সন্দেহ দূর হয়। এরপর বলেন, কত বড় ও কোন প্রজাতির কচ্ছপ লাগবে। বড় সাইজের কচ্ছপের কথা জানালে সময় নিয়ে ফোন রেখে দেন।

পরদিন শনিবার (২২ মে) সকাল পৌনে ৭টার দিকে সঞ্জয় দাস ফোনে জানান, তিন কেজি ওজনের ডাউঙ্গা প্রজাতির কচ্ছপ দিতে পারবেন। যার মাংস খুব সুস্বাদু।তবে আরও বড় সাইজের কচ্ছপ লাগবে, না দিতে পারলে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলা হয়।এতে কিছুটা অপমানিত বোধ করেন সঞ্জয়। রাগান্বিত স্বরে বলেন, আমি না দিতে পারলে বরিশালের আর কেউ দিতে পারবে না। এরপর তিনি প্রশ্ন করেন কচ্ছপ কী কাজে প্রয়োজন। তাকে বলা হয় কচ্ছপের খামারের কথা। জবাবে সঞ্জয় নতুন বাজারে দেখা করে অতি বিরল প্রজাতির কচ্ছপের ছবি দেখে কনফার্ম হয়ে টাকা পরিশোধ করতে হলেন। এরপর বাসায় কচ্ছপ পৌঁছে যাবে বলে জানান।

কচ্ছপের দাম সম্পর্কে সঞ্জয় দাস বলেন, নাহাসি প্রজাতির কেজি ১৬০০, ডাউঙ্গা ও সোম ১২০০। এছাড়া সুন্ধি, কাঠা প্রজাতির কচ্ছপ ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা পড়বে। এছাড়া আরও কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ সংগ্রহ করে দিতে পারবেন। কিন্তু সেগুলো অতি বিরল প্রজাতির হওয়ায় কয়েকগুন বেশি দাম পড়বে।

কথোপকথনের এক পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয়, নিষিদ্ধ ব্যবসায় পুলিশ বা বন দফতরের লোক কিছু বলে কি না? জবাবে সঞ্জয় দাস বলেন, লুকিয়ে ব্যবসা করি। অনেকেই টের পায় না। এছাড়া সবার সঙ্গে বেচাকেনা করি না বলে জানান তিনি।

বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান মো. মতিয়ার রহমান জানান, মিঠা পানির কচ্ছপ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য খেয়ে বাঁচে। জলাভূমিতে মরা, গলা, পচা, ময়লা জিনিস খেয়ে পানি পরিষ্কার রাখে। মশার লার্ভাও খায়। সুন্ধি কচ্ছপ থাকা জলাশয়ে পানি স্বচ্ছ ও মাছ দ্রুত বড় হয়। সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কচ্ছপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মন খারাপের ব্যাপার হলো, মানবসৃষ্ট কারণে বেশিরভাগ প্রজাতির কচ্ছপই এখন বিলুপ্তির মুখে।

তিনি বলেন, ১৫-২০ বছর আগেও দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলে ১৫-১৬ প্রজাতির কচ্ছপ দেখা যেত। কিন্তু নদীর নাব্যহীনতা, দূষণ, ভরাট, যত্রতত্র মাছের খামার, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও বন বিভাগের তদারকি না থাকায় নির্বিচারে চলছে কচ্ছপ নিধন।দেশে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণে অনেক আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। আইনের প্রয়োগ ও জনসচেতনা বাড়লেই বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ রক্ষা সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. নূরজাহান সরকার জানান, বিশ্বে যে কয়েকটি প্রাণী দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে কচ্ছপ তার অন্যতম। কচ্ছপরা ২০০ মিলিয়ন বছর সবরকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলে পৃথিবীতে টিকে রয়েছে।তবে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণেই এখন বিলুপ্তির পথে । পৃথিবীতে প্রায় ৩২০ প্রজাতির কচ্ছপ ছিল। এর প্রায় ১৫ প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। দেশে প্রায় ৩০ প্রজাতির কচ্ছপ ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি সামুদ্রিক, দুটি স্থলচর ও বাকি মিঠাপানির। বর্তমানে মিঠাপানির বেশ কয়েকটি ও সামুদ্রিক প্রায় সবকটিই বিলুপ্তির পথে।

আশঙ্কাজনকভাবে কচ্ছপের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে কচ্ছপের ডিম, মাংস, খোলস, হাড় ও চর্বির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কেউ কেউ কচ্ছপের মাংস আয়ু বাড়ার ওষুধ মনে করেন। অনেকেই বাত-ব্যাথার জন্য চর্বি থেকে তৈরি তেল ব্যবহার বা মাংস খান। খোলস দিয়ে তৈরি হয় নানা মূল্যবান সামগ্রী। ওষুধ তৈরির কাজে হাড় ব্যবহার হয়। এ ব্যবসায় দ্রুত অনেক টাকা উপার্জন করা যায়। তাই টাকার লোভে নির্বিচারে শিকার হচ্ছে কচ্ছপ।

বরিশাল বিভাগীয় বন কর্মকতা জি এম রফিক আহমেদ বলেন, প্রকাশ্যে বা গোপনে বরিশালে কোথাও কচ্ছপ বেচাকেনার কথা জানা নেই। কোথাও বিক্রি হলে তা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আগৈলঝাড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুর রব হাওলাদার জানান, কচ্ছপ বিক্রির কথা জানা নেই।সাহেবেরহাট ও রথখোলা বাজারে খোঁজ নেয়া হবে। সত্যতা পেলে অভিযান চালানো হবে।

এএইচ/এএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।