কোটি টাকার জমি লিখে দিয়েও সন্তানদের কাছে ঠাঁই মিলছে না মায়ের
রিজিয়া বেগমের (৬৫) স্বামী মারা গেছেন ২২ বছর আগে। স্বামী হাসেম গাজী বরিশাল নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা কাজীপাড়া এলাকায় ১২ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। সেখানেই টিনের চালার একটি ঘরে বসবাস করতেন রিজিয়া বেগম। স্বামী হাসেম গাজী মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ক্রয়করা ওই ১২ শতাংশ জমি স্ত্রী রিজিয়া বেগমের নামে লিখে দিয়ে যান। হাসেম গাজী ও রিজিয়া দম্পতির চার মেয়ে ও দুই ছেলে।
মৃত্যুর আগে হাসেম গাজী দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। দুই ছেলে তখনো ছোট। বাকি দুই মেয়ের তখনো বিয়ে হয়নি। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরেছিলেন রিজিয়া বেগম।
রিজিয়া বেগমের সম্বল বলতে ছিল স্বামীর পেনশনের সামান্য কিছু টাকা আর ১২ শতাংশ জমি। ছেলেমেয়ের মুখে খাবার জোটাতে কখনো কখনো নিজেদের পেটে দানা পড়েনি এই রিজিয়া বেগমের। ছেলেমেয়েদের বড় করতে গিয়ে একটা সময় খুব আর্থিক সংকটে পড়েন। স্বজনদের কাছে টাকার জন্য হাত পেতেছেন। ধার চেয়েছেন। তবে সবাই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন উপায় না দেখে নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা কাজীপাড়া এলাকায় বাড়ির ১২ শতাংশ জমি থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন। এভাবেই একে একে সবাইকে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
রিজিয়া বেগম তার বড় মেয়ে দেলোয়ারা ও সেজ মেয়ে উম্মে সালমাকে একটু বেশি ভালোবাসতেন। একটা সময় ওই দুই মেয়ে সংসার চালাতে টিউশনি করে মা রিজিয়া বেগমের হাতে টাকা তুলে দিতেন। যখন তিনি দেখলেন তার সন্তানরা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছেন তখন নিজের নামে থাকা সাড়ে ৬ শতাংশ জমি বড় মেয়ে দেলোয়ারা ও সেজ মেয়ে উম্মে সালমার নামে লিখে দেন। কথা ছিল মায়ের ভরণপোষণ করবেন ওই দুই মেয়ে। তার অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে বড় মেয়ে দেলোয়ারা ও সেজ মেয়ে উম্মে সালমার আর্থিক অবস্থা ছিল ভালো। সেজ মেয়ে উম্মে সালমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন কানাডাপ্রবাসী এক ছেলের সঙ্গে।
বিয়ের পর সালমা স্বামীর সঙ্গে কানাডায় বসবাস শুরু করেন। বড় মেয়ে দেলোয়ারা স্বামী নিয়ে বরিশাল নগরীতেই থাকতেন। মেজ মেয়ে থাকেন নগরীর সিঅ্যান্ডবি রোড। ছোট মেয়ে থাকেন ঝালকাঠি শহরে। দুই ছেলে থাকেন পৈত্রিক টিনের চালার সেই বাড়িতে।
তবে রিজিয়া বেগম জমি লিখে দেয়ার কারণে ওই জমি এখন কানাডাপ্রবাসী তার সেজ মেয়ে উম্মে সালমার। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর আগে তাদের বাড়ি লাগোয়া সোয়া ৩ শতাংশ জমি বিক্রি করলে দেলোয়ারা ও উম্মে সালমা কিনে নেন। তখন তারা বলেছিলেন, ওই জমিতে ভবন নির্মাণ করে তারা পরে সমান সমান ভাগাভাগি করে নেবেন। উম্মে সালমার অংশে থাকবেন মা রিজিয়া বেগম। তাছাড়া উম্মে সালমার আর্থিক অবস্থা ছিল অন্যদের চেয়ে ভালো। ভাইদের বিপদ-আপদে পাশে থাকবেন। এরপর দুই বোন মিলে একতলা ভবন নির্মাণ করেন। ওই ভবনে রিজিয়া বেগম বসবাস শুরু করেন।
তিন বছর আগে দেলোয়ারা বেগমের স্বামী মারা গেলে তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ওই একতলা বড়িতে ওঠেন। এরপরই দেখা দেয় নানা সমস্যা। বড় মেয়ে দেলোয়ারা এক ছাদের নিচে মাকে নিয়ে থাকতে রাজি নন। মা-মেয়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। মেয়ের দুর্ব্যবহারের কারণে ওই বাড়ি থেকে প্রায় চার মাস আগে নেমে যেতে বাধ্য হন মা রিজিয়া বেগম। আশ্রয় নেন ছোট ছেলে ফারুক হোসেনের ঘরে। কিন্তু সেখানেও কয়েকদিন থাকার পর ছেলে ও বউয়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। ঝগড়ার জন্য রিজিয়া বেগমকে দোষারোপ করেন ছেলে বউ। ছেলের সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে সেখান থেকে চলে যান রিজিয়া বেগম। এরপর আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকতে শুরু করেন।
মাসখানেক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন রিজিয়া বেগম। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। কিছুদিন আগে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরই মধ্যে বড় মেয়ে দেলোয়ারা বেগম সেজ বোন উম্মে সালমার অংশ নিজের বলে দাবি করেন। কৌশলে পুরো জমি নিজের নামে করতে সিটি করপোরেশন থেকে দেলোয়ারা বেগম তার নামে প্ল্যান পাস করিয়ে নেন। বিদ্যুৎ ও পানির বিলও করিয়ে নেন তার নামে।
এদিকে মা রিজিয়া বেগম তার আত্মীয়ের বাড়িতে ভালো ছিলেন না। বুধবার (১২ মে) রাতে সেখান থেকে চলে আসেন কাজীপাড়া এলাকার দুই মেয়ে মিলে নির্মাণ করা সেই একতলা বাড়িতে। কিন্তু সেখানে আশ্রয় হয়নি রিজিয়া বেগমের। বড় মেয়ে দেলোয়ারা বেগম তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করলে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পুলিশ সদস্যরা। তবে কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। বড় মেয়ে দেলোয়ারা মা রিজিয়া বেগমকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘১৯৯৮ সালে তার স্বামী মারা যান। এরপর অনেক কষ্ট করে তিনি ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। সন্তান বড় হলে তাদের নিয়ে বাবা-মা হাজারো স্বপ্ন দেখেন। কোনো কোনো সন্তান বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে আবার কেউ তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটবে ভাবতেও পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমার নামে ১২ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের বড় করতে গিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ জমি বিক্রি করেছি। জমি বিক্রির অর্ধেক টাকা ছেলেমেয়েদের ভাগ করে দিয়েছি। বাকি সাড়ে ৬ শতাংশ জমি দুই মেয়ের নামে লিখে দিয়েছি। স্বপ্ন ছিল সেখানে বাড়ি করে ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে থাকবে। তাদের সঙ্গে আমি থাকব। নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো আনন্দে কাটবে। তবে আজ আমারই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এই কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না।’
দক্ষিণ আলেকান্দা কাজীপাড়া এলাকা বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মেহেদি পারভেজ খান আবির জানান, গত কয়েক বছর ধরে রিজিয়া বেগমের ছেলেমেয়েদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ চলছে। জমি নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে মারামারি ও মামলা পর্যন্ত হয়েছে। বিরোধ মেটাতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের নিয়ে অন্তত ২০ বার সালিশ বৈঠকে বসেছেন। তবে ভাইবোনরা কেউ কাউকে সামন্য ছাড় দিতে রাজি নন। কারণ ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘রিজিয়া বেগমকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না তার বড় মেয়ে দেলোয়ারা বেগম। আজ (বুধবার) রাত ৮টার দিকে এমন খবর পেয়ে সেখানে যাই। পুলিশ সদস্যরাও আসেন। রিজিয়া বেগমকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে তার মেয়ে দেলোয়ারা বেগমকে বার অনুরোধ করা হয়। দেলোয়ারা বেগম দাবি করেন, একতলা বাড়িটির মালিক তিনি একা। ওই বাড়িতে কারো অংশ নেই। তাই তার মা রিজিয়া বেগমসহ অন্য ভাইবোনদের ঘরে ঢুকতে দেয়া হবে না। এরপর রিজিয়া বেগমের ছোট ছেলে ফারুক হোসেনের ঘরে তার মাকে থাকতে দিতে অনুরোধ করা হয়। তবে ফারুক ও তার বউ এতে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাদের বলা হয় ঈদের পর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের জমি বিরোধ মেটাতে আবার সালিশে বসবেন। সেই পর্যন্ত রিজিয়া বেগম যেন তাদের সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়। এরপর ফারুক ও তার বউ তাদের ঘরে ঢুকতে দেন রিজিয়া বেগমকে।’
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে দেলোয়ারা বেগমের মোবাইলে কয়েকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান জানান, নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা কাজীপাড়া এলাকায় জমি নিয়ে ঝামেলার খবর পেয়ে সেখানে একজন নারী এসআইয়ের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পাঠানো হয়। পুলিশ সদস্যরা বিষয়টি সমাধানের জন্য রিজিয়া বেগম ও তার ছেলেমেয়েদের অনুরোধ করেন। তবে তারা পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলর এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কারো অনুরোধই রাখেননি। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় কাউন্সিলর এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঈদের পর বিষয়টি নিয়ে আবার সালিশ বৈঠকে বসার কথা জানান। এরপর রিজিয়া বেগমকে ঘরে তুলতে রাজি হন তার ছেলে ফারুক হোসেন। সালিশ বৈঠক পর্যন্ত রিজিয়া বেগম ছোট ছেলে ফারুকের ঘরে থাকবেন।
সাইফ আমীন/এসআর/এমকেএইচ