ভালো নেই পাবনার হকার বাতেন ভাই

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা
প্রকাশিত: ১২:৫৪ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২১

অডিও শুনুন

দীর্ঘ ৪০ বছর পত্রিকা বিক্রি করে বহু মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছেন পাবনার আব্দুল বাতেন। উপজেলা সদরের একমাত্র পত্রিকা বিক্রেতা হিসেবে গত ৪০ বছর ধরে এলাকার মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন খবরের কাগজ। পরে আরও অনেকেই এই পেশায় এলেও তার ব্যবহারে মুগ্ধ সবাই বিকল্প কারও কাছ থেকে পত্রিকা নেননি কখনোই।

৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পত্রিকা এনে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া সেই মানুষটি আজ ভালো নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে পত্রিকা আনতে যাওয়ার পথে স্ট্রোক হয় তার, সেই থেকে শয্যাশায়ী তিনি।

বাতেন ভাইয়ের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা টের পাওয়া যায় ওই এলাকায় গিয়ে। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা সদরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা তার পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন।

তিনি বলেন, পত্রিকা রাখার কারণ যতটা না পড়া, তারচেয়েও বড় কারণ হলো বাতেন ভাইয়ের সঙ্গে যেন প্রতিদিন একটু দেখা হয়, কথা হয়। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সব খবর যখন হাতের মুঠোয়, ঠিক তখনও আব্দুল বাতেনের হাত থেকে পত্রিকা কেনেন সবাই।

কিন্তু বয়সের ভারে আজ ন্যুব্জ তিনি। ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সের শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছেন। স্ট্রোক করার পর থেকে এ পেশাটি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার জন্য। চিকিৎসা করানোর মতো টাকাও নেই তার হাতে। সবার সহযাগিতা নিয়ে একটি স্টেশনারি দোকান দিয়ে আবারও জীবিকা নির্বাহ করতে চান।

আব্দুল বাতেনের কাছ থেকে শোনা গেল তার হকার জীবনের শুরুর কথা। তিনি জানান, তার বাবা সাঁথিয়া উপজেলার ঘুঘুদহ গ্রামের মৃত ফজলুর রহমান। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হলেও তরুণ বয়স থেকেই অন্যের বাড়িতে কৃষি কাজ করতেন তিনি। প্রায় ৪০ বছর আগে তার এক আত্মীয় শাহজাহান খন্দকারের সাথে তিনি নগরবাড়ী ঘাট থেকে পত্রিকা এনে সাঁথিয়া উপজেলা সদরে বিক্রি করতেন। তখন তাকে প্রতিদিন যাতায়াত করা লাগত প্রায় ৮০ কিলোমিটার। তখন পত্র-পত্রিকার সংখ্যা কম ছিল, গ্রাহকও ছিল হাতেগোনা।

নব্বইয়ের দশকে পত্রিকার সংখ্যা বাড়তে থাকে, সাথে পাঠকও বাড়ে। ৯০’র দশকে সেই আত্মীয় শাহজাহান খন্দকার পত্রিকার এজেন্ট হলে তার পত্রিকা আসত পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের বনগ্রাম নামক স্থানে। আব্দুল বাতেন বনগ্রাম থেকে কাগজ নিয়ে হকারি জীবন শুরু করেন।

jagonews24

তিনি জানান, এতে তার পথ চলার দূরত্ব অর্ধেক কমে ৪০ কিলোমিটার হয়। তবে বনগ্রাম থেকে পত্রিকা নিয়ে সাঁথিয়ায় বিতরণ করে আবার ১৫ কিলোমিটার দূরে বাড়ি আসাটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তিনি সাঁথিয়া পৌর সদরে ইছামতি নদীর তীরের এক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

বাবার কোনো সহায়-সম্পত্তি না থাকায় তিনি পৈত্রিক সূত্রে কিছুই পাননি। পত্রিকা বিক্রি করে যা কমিশন পান তা দিয়েই চলতো সংসার। এখন পত্রিকা ব্যবসা ধরে রাখতে পারছেন না শারীরিক অসুস্থতার জন্য। সংসারে ৪ মেয়ে ১ ছেলে রয়েছে তার। ছেলেটি সবার ছোট হওয়ায় সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই।

জানালেন, সবার সহযোগিতায় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখনও দুটো মেয়ে অবিবাহিত। সংসারে রোজগার না থাকায় কষ্টে আছেন তিনি।

আব্দুল বাতেন জানান, পত্রিকা বিক্রি করে সংসার চালানো ছাড়া আর কোনো সঞ্চয় করতে পারেননি। তবে টাকা পয়সা না থাকলেও মানুষের ভালোবাসা আছে তার সাথে। ৩ বছর আগে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন তিনি। তখন স্থানীয় সাংবাদিকরা, পৌরসভা মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিলে ১০ হাজার টাকা সহায়তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সবার সহায়তায় সেই যাত্রায় সুস্থ হন তিনি। কিন্তু এবার স্ট্রোক করার পর আর কেউ সেভাবে সাহয্যের হাত বাড়ায়নি।

তার শরীরের যে অবস্থা তাতে তার প্রিয় সেই পেশায় আর ফিরতে পারবেন না। বরং পৌর সদরে একটি স্টেশনারি দোকান দিয়ে বাকি জীবন পার করতে চান। জানালেন ৫০ হাজার টাকা পেলেও বাড়ির সামনে একটি টং দোকান দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, সারাদেশের পত্রিকার মালিক-সম্পাদক, সাংবাদিক কিংবা দেশ-বিদেশের হৃদয়বান ব্যক্তিরা একটু সহযোগিতার হাত বাড়ালেই তার সংসারটা চলতে পারে।

jagonews24

সাঁথিয়ার স্থানীয় লোকেদের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, সারাটি জীবন খবর বয়ে বেড়ানো লোকটির প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই কোনো।

সাঁথিয়া পৌর সদরের ওষুধ বিক্রেতা মাসুদ রানা জানালেন, তিনি ১৯৯০ সাল থেকে বাতেনকে চেনেন।
তার প্রতি সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে সংসারের একটা গতি হবে।

সাঁথিয়া ডিগ্রী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুদ দাইন জানান, রোদ ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর ঘরের দুয়ারে পত্রিকা পৌঁছে দিয়ে গেছেন বাতেন। তিনি অসুস্থ বলে এখন সাঁথিয়ায় পত্রিকা আসাই অনিয়মিত হয়ে গেছে।

সাঁথিয়ার সংবাদপত্র এজেন্ট শাহজাহান আলী বলেন, সংবাদপত্র ব্যবসায় এমনিতেই এখন খারাপ অবস্থা। এর উপর করোনা আসায় সার্কুলেশন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে এজেন্টরা বিপদে আছে, এর চেয়ে বড় বিপদে হকাররা। সবার আয় বছরে বাড়ে কিন্তু তাদের আয় প্রতি বছর শুধু কমছেই। তারপরও আব্দুল বাতেন কোনোমতে তার হকারি টিকিয়ে রেখেছিলেন। বয়সের কারণে আর অসুস্থতায় এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।

সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম জামাল আহমেদ জানান, তিনি সাঁথিয়ায় আসার পর থেকেই আব্দুল বাতেনকে চেনেন। তার দুরাবস্থার কথা তিনি জানার পর করোনাকালে তাকে দু’বার কিছু সহযোগিতাও করেছেন। যা সাময়িকভাবে তার সংসারের চাহিদা মিটিয়েছে। এখন দেশ-বিদেশের দানশীল ও হৃদয়বান মানুষেরা এগিয়ে এলে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে ভালভাবে বাঁচতে পারবেন।

কেউ আব্দুল বাতেনের জন্য মানবিক সহযোগিতা করতে চাইলে জাগো নিউজের পাবনা জেলা প্রতিনিধি আমিন ইসলামের ০১৭১৫-৫৭৬৭৬২ অথবা ০১৮১৮-৪৮৩১৩৮ মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।