ধান নেই, তাহলে কীভাবে এলো ‘মিনিকেট’ চাল?
স্বাদে জুড়ি নেই মিনিকেট চালের ভাতের। এ চালের ভাতের রসনা তৃপ্তির জন্য ব্যাকুল মানুষ। অথচ দেশে ‘মিনিকেট’ নামে কোনো ধানের জাত না থাকলেও এই নামে প্রতারণার মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এক শ্রেণির চালকল মালিক মোটা চাল ছেঁটে সরু করে ‘মিনিকেট’ বলে বাজারজাত করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুটে নিচ্ছে। প্রায় ১ মাস ধরে অনুসন্ধানে বের হয়েছে এমন তথ্য।
কৃষিবিদ বজলুর রশিদ জানান, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার ভারতীয় জাতের ধান চাষ হয়। কিন্তু মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত বাংলাদেশ কিংবা ভারতেও নেই। মিনিকেট চাল নামে বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মশিদুল হক জানান, কয়েক বছর হলো এখানকার কৃষকদের মাঝে ‘মিনিকেট ধান’ চাষের প্রবনতা দেখা গেছে। স্থানীয়ভাবে কৃষকরা এটাকে মিনিকেট বললেও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে এই ধানের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ভারত থেকে আসা কথিত এই ধানই মিনিকেট বলে চাষ করেন স্থানীয় কৃষকরা। এ কারণে এই উপজেলায় সাড়ে ২২ হাজার হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে বেশিরভাগই কথিত মিনিকেট ধান দিয়ে ভরা থাকে।
তিনি জানান, সম্প্রতি বাংলাদশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ব্রি-৫৭ নামের একটি ধান অনুমোদন দিয়েছে। এই ধান কথিত মিনিকেটের মতোই চিকন। ফলনও হয় বেশি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অটোরাইস মিলে রয়েছে একটি অতি বেগুনি রশ্নির ডিজিটাল সেন্সর প্লান্ট। এরমধ্যে দিয়ে যেকোনো ধান বা চাল পার হলে সেটি থেকে প্রথমে কালো, ময়লা ও পাথর সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর মোটা ধান চলে যায় অটোমিলের বয়লার ইউনিটে। সেখানে পর্যায়ক্রমে ৫টি ধাপ পার হওয়ার পর লাল কিংবা মোটা চাল সাদা রঙ ধারণ করে। এরপর আসে পলিশিং মেশিং। অতি সুক্ষ এই মেশিনে মোটা চালের চারিপাশ কেটে চালটিকে চিকন আকার দেয়া হয়। এরপর সেটি আবারও পলিশ ও স্টিম দিয়ে চকচকে শক্ত আকার দেয়া হয়। শেষে সেটি হয়ে যায় কথিত এবং আকর্ষণীয় মিনিকেট চাল।
কীভাবে এলো মিনিকেট
মিনিকেট নামের উৎপত্তি নিয়ে আরেক কৃষিবিদ সিরাজুল করিম চমৎকার তথ্য দেন। তিনি জানান, ১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন ‘শতাব্দী’ ধানের বীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদের এ ধান বীজের সাথে কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি ‘মিনিপ্যাকেট’ দেয়া হয়। মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান শেষমেশ মিনিপ্যাকেট শব্দটির ‘প্যা’ বাদ দিয়ে মিনিকেট বলে পরিচিতি লাভ করে। এটিই পরে চলে আসে বাংলাদেশে।
কৃষি বিভাগের অন্য একটি সূত্র জানায়, ৯৫ পরবর্তী সময়ে বোরো মৌসুমে সেই মিনিপ্যাকেটের শতাব্দী ধানের বীজ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছে যায়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার চাষিরা এনে সর্বপ্রথম এ ধানের চাষ শুরু করেন। আমাদের দেশে আগে নাজিরশাইল, পাজাম ও বালাম ধানের চাষ হত। এসব দেশি সরু ধানের চালের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
বরিশালের বালামের সুনাম ছিল ভারত উপমহাদেশব্যাপী। কালের বিবর্তনে সব সরু জাতের ধান চাষ উঠে যায়। সরু চালের সন্ধান করতে থাকেন ক্রেতারা। এ সময় বাজারে কথিত মিনিকেটের আবির্ভাব ঘটে। ক্রেতারা লুফে নেয় এ সরু জাতের চাল। সুযোগ বুঝে এক শ্রেণির মিল মালিক মাঝারি সরু বি আর-২৮, বিআর-২৯ ও বি আর-৩৯ জাতের ধান ছেঁটে ‘মিনিকেট’ বলে বাজারজাত করতে শুরু করেন। বর্তমানে সারা দেশে চিকন চাল বলতে এখন ‘মিনিকেট’ই বোঝায়, যার দামও চড়া। দেখতেও চকচকে, আকর্ষণীয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, একমাত্র পশ্চিমের জেলা যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গাতে ভারত থেকে আসা কথিত সেই ‘মিনিকেট’ ধানের চাষ হয়। বিগত মৌসুমে যশোর জেলায় ৩০ হাজার হেক্টরে, ঝিনাইদহ জেলায় ১৮ হাজার হেক্টরে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় তিন হাজার হেক্টরে ও মাগুরা জেলায় এক হাজার হেক্টর কথিত এ মিনিকেট ধানের চাষ হয়।
এর বাইরে যেসব জেলায় মিনিকেট ধান বা চালের কথা বলা হয় সেটি পুরোপুরি ভুয়া। মোটা চাল ছেঁটে তৈরি করা চালই মিনিকেট নামে সেখানে পরিচিত।
বগুড়ার তালোড়া, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর বাজারের একাধিক চালকল ব্যবসায়ী জানান, উত্তরের সীমান্তবর্তী জয়পুরহাট, নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর জেলায় ‘মিনিকেট’ ধান উৎপাদন হয় না। এখানকার এক শ্রেণির অসাধু চালকল মালিক বিআর-২৯ ও বিআর-৩৯ জাতের চাল ফিনিশিং করে মিনিকেট বলে বাজারজাত করছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া সদর, শেরপুর ও দুপচাঁচিয়া থেকে সারাদেশে কথিত মিনিকেট চাল সরবরাহ করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই লাখ লাখ মণ মিনিকেট চালের যোগান আসছে কোথা থেকে। কারণ গত বছর যে ধান উৎপাদন হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ এক লাখ টন চাল হওয়ার কথা। ফলে মিনিকেট নিয়ে প্রতারণার রমরমা বাণিজ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে চাল ব্যবসায়ীদের মাঝে।
তালোড়া বাজারের আড়তদার শামসুল হায়দার, শেরপুরের আবির হোসেন ও দুপচাঁচিয়ার লদু প্রমানিক জানান, অটোরাইচ মিল মালিকরা যে চাল সরবরাহ করছে, তাই মিনিকেট বলে বাজারে বিক্রি করছি। আমরা যেভাবে কিনব সেভাবে বিক্রি করব এটাই স্বাভাবিক।
এই ব্যবসায়িরা স্বীকার করেন যে মিনিকেট নামে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই। বিআর-২৮, কল্যাণী, রত্না, বেড়ে রত্না, স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, আইঅর-৫০, জাম্বু ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বস্তায় ভরে বিক্রি করা হয়। বাজারে এ চালের ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রতারণার ব্যবসা চলছে বলেও তারা মনে করেন।
কৃষি বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা আকবর আলী জানান, পাঁচ বছর আগে বোরো মৌসুমে চাষের জন্য ভারতের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘সুপার ফাস্ট’ নামে একটি সরু জাতের ধান অবমুক্ত করে। এ ধানের চাল একশ্রেণির মিল মালিক ‘সুপার মিনিকেট’ বলে এখন বাজারে বিক্রি করছে। এ চাল কথিত মিনিকেটের চেয়ে আরও বেশি চিকন।
তিনি আরও জানান, দেশব্যাপী মিনিকেট চালের নামে যে প্রতারণা চলছে তা কেবল ক্রেতাদের মাঝে সচেতনা বৃদ্ধি হলেই নিরসন সম্ভব।
বিষয়টি নিয়ে কৃষিবিদ ড. শমসের আলী জানান, মিনিকেট নামে কোনো জাতের ধান বাংলাদেশে নেই। এটা প্রতারণা। এই প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের সৎ হতে হবে। চাল ব্যবসায়ীরা আসল পরিচয়ে চাল বিক্রি করলে ক্রেতারা প্রতারিত হবেন না। আমাদের চাল বাজারগুলো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে তারা ইচ্ছামতো নাম দিয়ে বাজারে চাল বিক্রি করেন।
কৃষি বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এফএ-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শওকত আলী স্বাক্ষরিত মিনিকেট ধান ও চাল সম্পর্কে এক বিশদ প্রতিবেদন বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘মোটা-লম্বা জাতের ধান বিশেষ করে বিআর-২৮ জাতের ধান রাবার রোলারে ক্রাসিং করে মিনিকেট নামে বাজারজাত করছেন চালের মিল মালিকরা। অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রচুর পরিমাণ মিনিকেট চালের সরবরাহ লক্ষ্য করা গেলেও সব চাল আসল মিনিকেট নয়। সাধারণভাবে চাল দেখে বোঝা না গেলেও ভাত রান্নার পর আকৃতির ধরণ দেখে বোঝা যায় এগুলো মিনিকেট নয়।’
কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে যে, ‘মিনিকেট চাল সরু বিধায় এ চাল দেশের উচ্চবিত্ত মহলে বেশ সমাদৃত। এ কারণে দিন দিন এ চালের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
দেশের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার চালের বাজারে মিনিকেটের বাজারই চার হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজারে যত চাল তার ২২ ভাগের একভাগই মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে। আর দেশের প্রায় ৮০০টি চালকল মিনিকেট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।
এফএ/এমএস