মাদক মামলায় সাক্ষীকে ‘মাতাল’ বানিয়ে হত্যাচেষ্টা, ঘরছাড়া বাবা-ছেলে
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার মাদারপুর গ্রামের চরাঞ্চল এলাকা থেকে দুই কেজি হেরোইন ও ১৯৭৮ পিস ইয়াবাসহ মো. আশরাফুল ইসলাম নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে গত ১৫ মার্চ রাত ১টার দিকে গ্রেফতার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহলরত একটি দল। ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকায় সাক্ষী হতে হয় মো. নাইমুল হক সেন্টু ও মো. সাদিকুল ইসলামকে। আটক প্রায় অর্ধকোটি টাকার মূল্যের মাদক মামলার সাক্ষী হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মো. নাইমুল হক সেন্টুর। এখন গৃহহীন দিনযাপন করছেন সাক্ষী সেন্টু ও তার ছেলে জুয়েল।
গত ২ এপ্রিল অর্ধকোটি টাকার মাদক মামলার সাক্ষী সেন্টুকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়ির সামনে মুখের মধ্যে দুটি পাইপ ঢুকিয়ে জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেই সঙ্গে ১২-১৫ জন মিলে লোহার পাইপ দিয়ে তার পুরো শরীর পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া হয় মাদক সম্রাট বাবু মেম্বারের নির্দেশে। উদ্দেশ্যে ছিল মাতাল সাব্যস্ত করে সেন্টুকে হত্যা করা। কিন্তু মাদক মামলার সাক্ষী সেন্টুর চিৎকারে এলাকাবাসী এগিয়ে আসলে পালাতে বাধ্য হয় মাদক সম্রাটের গুন্ডা বাহিনী।
প্রতিবেশীর ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন সন্তান জুয়েল। রক্তাক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে বাবাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও বিপদের মুখে পড়তে হয় গুরুতর আহত সেন্টু ও তার সন্তানকে। রামেকের গেটেই অপেক্ষায় ছিলেন মাদক সম্রাট বাবু মেম্বারের ভাড়াটে গুন্ডারা। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখান থেকেও পালিয়ে প্রাণে বাচেন তারা। এলাকার পরিচিত এক আত্মীয়ের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় নাইমুল হক সেন্টুকে। নেন প্রাথমিক চিকিৎসা।
তবে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসক তাকে পরামর্শ দেন রামেকে ভর্তি হওয়ার। পরবর্তীতে প্রশাসনের সহযোগিতায় ৩ এপ্রিল ভর্তি হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। রামেক থেকে চিকিৎসা নিয়ে আশ্রয় নেন নিকটাত্মীয়ের বাসায়। এখন পর্যন্ত আশ্রিত রয়েছেন বাবা ও ছেলে।
সাক্ষী সেন্টুর ছেলে জুয়েলের দাবি, ‘এলাকায় ফিরলেই লাশ হয়ে কবরে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় সাক্ষী হওয়ার পরও আমার বাবা কোনো সুরক্ষা পাননি। উল্টো তাকে প্রতিনিয়তই মোবাইলে ভয়ভীতি দেয়া হচ্ছে। এমনকি কোর্টে সত্য না বলার জন্য বাবু মেম্বার মোটা অঙ্কের টাকারও প্রলোভন দিচ্ছেন। বাবা যেন সাক্ষ্য না দেন সেজন্য বারবার চাপ দিচ্ছেন তারা। তাদের ভয়ভীতি ও আর্থিক প্রলোভনের সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় বৃদ্ধা মাসহ দুই প্রতিবন্ধী ভাইবোন রয়েছেন। বাবা-ছেলে বাড়িতে না থাকায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাড়িতে ফিরতে না পারায় তাদের জীবনেও চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। অসহায় বৃদ্ধ মাকেও প্রায়ই বাবু মেম্বারের লোকেরা গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসেন। সবমিলিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আমাদের দিন কাটছে।’
মাদক মামলার প্রধান সাক্ষী নাইমুল হক সেন্টু বলেন, ‘গোদাগাড়ী অঞ্চলে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী সেতাবুর রহমান বাবু। ৫-৬ বছর আগেও বাবু ছিল ট্রলির লেবার। মাদকের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যায় সে। সেই টাকার জোরে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বারের পদও বাগিয়েছে বাবু। এখন পুরো মাটিকাটা ইউনিয়নে চলে বাবু মেম্বারের ত্রাশের রাজত্ব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাতেও তার নাম রয়েছে। দুই কেজি হেরোইন ও প্রায় দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক ওই ব্যবসায়ী তারই লোক। তার বিরুদ্ধে কথা বলায় আজ আমার এই হাল।’
পুলিশের বিরুদ্ধে সাক্ষী সেন্টুর অভিযোগ, ‘পুলিশ প্রশাসন সবই তার (মেম্বার বাবু) পকেটে। মাঠে কাজ করে বাড়ি ফেরার পথে সেতাবুর রহমান সেতা (৩৯), আরিফুল ইসলাম (৪০), সেলিম (৩২), মোতালেব (৩৪), সাইদুর (২৬), পিএস (২২), উজ্জ্বলসহ (২৩) আরও ৭-৮ জন মিলে আমাকে মারধর করেন। এতে হাতের দুই আঙুল ভেঙে যায়। এসময় দুই পাইপ দিয়ে জোরপূর্বক আমার মুখের মধ্যে মদ ঢেলে দেন তারা। তাদের লোহার পাইপের আঘাতে আমার সামনের একটি দাতও ভেঙে যায়। এলাকাবাসী রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে পুলিশকে জানানো হয়, কিন্তু পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
এ বিষয়ে জুয়েল বলেন, ‘বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে এসআই হাবিবকে জানালে তিনি ওসির নম্বর দেন। পরবর্তীতে ওসিকে ঘটনাটি জানালে তিনি বলেন, মামলার বিষয় পরে দেখা যাবে, আগে নিজে বাঁচো। পরে বেশ কয়েকবার তার মোবাইলে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। তাদের অসহযোগিতার কারণে আর যোগাযোগ করিনি।’
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বিজিবির নায়েক সুবেদার মো. আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, ‘বিজিবির সাক্ষ্য হওয়ার জন্য সেন্টুকে হামলার স্বীকার হতে হয়েছে, এটি সত্য নয়। তার হয়তো ব্যক্তিগত সমস্যা থাকতে পারে। সে কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে মাদক মামলার সাক্ষী হওয়াটা বড় বিষয় নয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ৮ নম্বর মাটিকাটা ইউনিয়নের মেম্বার সেতাবুর রহমান বাবু বলেন, ‘এসব কথা অসত্য ও ভিত্তিহীন। আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে কাউকে মারার নির্দেশ দিইনি। বরং সেখানে গন্ডগোল হওয়ার আভাস পাওয়ায় সেন্টুর ভাস্তেকে সতর্ক করে দিই, সেন্টু যেন কোনো বিষয়ে কারো সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে না জড়ায়, অন্যথায় ঝামেলা হতে পারে।’
তিনি মোবাইলে সেন্টুর ছেলে জুয়েলকে রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলার বিষয়টি স্বীকার করেন। পাশাপাশি কোনো প্রকার মামলা মোকদ্দমায় না জড়িয়ে আপোষ মীমাংসার জন্য সমঝোতা করার প্রস্তাবও দেন।
এ বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খলিলুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ওই ঘটনায় তারা কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেননি। মামলা দায়ের হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ফয়সাল আহমেদ/এসআর/এমকেএইচ