পুরুষের ডিএনএ পরীক্ষায় আসছে নারীর রিপোর্ট!

ইউসুফ দেওয়ান রাজু
ইউসুফ দেওয়ান রাজু ইউসুফ দেওয়ান রাজু সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২১

সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে মৃতদেহের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ এবং তা সংরক্ষণ নিয়ে গুরুতর অভিযাগ উঠেছে। দায়সারা এবং ভুলভাবে মৃতদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করায় অনেক ক্ষেত্রেই মৃতদেহের সঠিক পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি পুরুষের ডিএনএ পাঠানো হলেও রিপোর্টে আসছে নারী হিসেবে। ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থেকে এমন তথ্য আসায় মামলা নিয়ে বিপাকে পড়েছে পুলিশ।

প্রশ্ন উঠেছে এই অবহেলার জন্য দায়ী ডাক্তার না ডোম? কার ভুলে এমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক।

২০২০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ৪টি থানা থেকে উদ্ধারকৃত অপঘাতে নিহত অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তের জন্য হাসপাতাল মর্গ থেকে সংরক্ষিত ডিএনএর ফলাফল ভুল এসেছে। আর এতেই সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ও ডোমের দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা সমালাচনা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম অভিযোগটি ওঠে ২০২০ সালে যমুনা নদী থেকে উদ্ধার করা একটি লাশ নিয়ে। সিরাজগঞ্জ সদর থানা পুলিশ যমুনা নদীর সয়দাবাদ এলাকা থেকে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পাঞ্জাবী ও লুঙ্গী পরা এক পুরুষের অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। মর্গ থেকে ডিএনএ সংরক্ষণের আবেদন করে পুলিশ।

ডাক্তার ও ডোম মৃতদেহ থেকে ডিএনএর নমুনা সংরক্ষণ করে ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অব বাংলাদেশ পুলিশ সিআইডিতে পাঠান। দীর্ঘ ৫ মাস পর ডিএনএ ফলাফলে উল্লেখ করা হয় যে মৃতদেহটি একটি নারীর। অথচ মামলা সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র এবং প্রেরিত আলামতে অজ্ঞাত পুরুষ মানুষের মৃতদেহ হতে সংগৃহীত বলে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে একাধিকবার ডিএনএ পরীক্ষায় উক্ত আলামত হতে নারীর ডিএনএ প্রোফাইলই পাওয়া যায়।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে উল্লাপাড়া থানাতেও। ফুলজোর নদী হতে এক বয়স্ক পুরুষের মৃতদেহ উদ্ধার করে ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করার পর হাসপাতাল থেকে পাঠানো কাগজপত্র ও সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃতদেহটিকে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে একাধিকবার পরীক্ষা করে সেটি এক নবজাতক কন্যা সন্তানের ডিএনএ বলে প্রাফাইলে পাওয়া যায়।

এছাড়া বেলকুচি ও রায়গঞ্জ থানাতেও এমন ভুল তথ্য এসেছে। যে কারণে এসব মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত আর মামলা পরিচালনা করতে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।

বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা জানান, গত বছরের ১ জুলাই বেলকুচি থানার একটি অজ্ঞাতনামা কিশোরীর লাশের বাবা-মা দাবি করে থানায় এজাহার করেন লালচান শেখ ও তার স্ত্রী পারভিন খাতুন। বিষয়টি নিশ্চিত করতে পুলিশ ওই দু’জনের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠায়। প্রথম দফায় ডিএনএ নমুনার পরীক্ষার ফলাফলে নমুনাটি একজন প্রাপ্ত বয়স্কের বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের অনুমতি নিয়ে পুলিশ নিহত কিশোরীর মাথার খুলির পাজরের হাড়, দাঁত ও চুল কবর থেকে সংগ্রহ করে পুনরায় পাঠায়। একই সাথে পুনরায় লালচান শেখ ও তার স্ত্রী পারভিন খাতুনের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এই দম্পতির নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ না করার কারণে ফরেনসিক বিভাগ তা গ্রহণ করেননি।

jagonews24

একই সাথে ফরেনসিক কর্তৃপক্ষ পুনরায় মৃত ব্যক্তির ২ আত্মীয়ের নমুনা নতুন করে সংগ্রহ কিংবা তাদের সরাসরি ঢাকা পাঠানোর পরামর্শ দেন। যে কারণে মামলার তদন্ত বিঘ্নিত হচ্ছে বলে তিনি জানান।

উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার দাস জানান, গত বছরের ১১ জুলাই উল্লাপাড়া থানার সড়াবিল এলাকা থেকে একটি অর্ধগলিত পুরুষের লাশ উদ্ধার করে তার ডিএনএ হাসপাতালে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গত ২১ জুলাই সলঙ্গা থানার চরগোজা গ্রামের গৃহবধূ সেলিনা খাতুন লাশটি তার স্বামীর বলে দাবি করেন। বিষয়টি নিশ্চিত হতে পুলিশ তার সাত বছরের জমজ দুই ছেলে রিফাত ও সিফাতের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ ল্যাবরেটরি অফ বাংলাদেশ পুলিশ দফতরে পাঠায়।

কিন্তু ফরেনসিক বিভাগ নমুনাটি পরীক্ষা করে গত বছরের ৫ অক্টোবর মৃত ব্যক্তির ডিএনএ’র নমুনাটি একজন মহিলার বলে শনাক্ত করে। বিষয়টি নিয়ে তিনি সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় মৃত ব্যক্তির সংগৃহীত নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে পুলিশকে পুনরায় বাধ্য হয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষা করতে হয়।

সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত সুইপার রানা হরিজন বলেন, আমিতো সুইপার, ডোম না। হাসপাতালে ডোম না থাকায় সুইপার হয়েও আমাকে ডোমের কাজ করতে হয়। ডাক্তাররা কখনই মৃতদেহ স্পর্শ করেন না। আমাকেই সব করতে হয়। যে কারণে ভুল হলে হতেও পারে।

ডাক্তাররা কেন এই আলামত সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার ফরিদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার সাইফুল ইসলাম জানান, এই ধরনের ভুল হওয়ার কথা না। তবে কেন এমন হলো তা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকের (আরএমও) সঙ্গেকথা বলে খতিয়ে দেখা হবে। যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম জানান, মামলা নিষ্পত্তির জন্য মৃতদেহের পরিচয় জানা অত্যন্ত জরুরি। যে কারণে পুলিশ ডিএনএ রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরপর চারটি রিপোর্টে বিভ্রান্তিকর তথ্য আসায় পুলিশকে মামলা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। তদন্ত কাজ এবং মামলা নিষ্পত্তিতেও বিঘ্ন ঘটছে। তিনি এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগকে কঠোর নজরদারির মধ্যে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানান।

ইউসুফ দেওয়ান রাজু/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।