অটোরিকশার আঘাতে ৩৫ দিন চিকিৎসা নিয়েও চালককে ক্ষমা করলেন সার্জেন্ট
রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল সড়কে গত ২ মার্চ ট্রাফিক আইন ভেঙে পালিয়ে যাচ্ছিল একটি অটোরিকশা। সেটিকে ধরতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে জ্ঞান হারান সার্জেন্ট সন্দ্বীপ মল্লিক। এরপর ঘটনাস্থল থেকে উধাও হয়ে যায় অটোরিকশার চালক।
ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে টানা ৩৫ দিন হাসপাতালে কাটাতে হয় সার্জেন্ট সন্দ্বীপ মল্লিককে। তিনি বর্তমানে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে (আরএমপি) কর্মরত।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে সার্জেন্ট সন্দ্বীপ বলেন, আইন ভেঙে পালিয়ে যাচ্ছিলো একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। তখন তিনি চেকপোস্টে দায়িত্বরত ছিলেন। খবর সেটিকে আটকানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু চালক ছুটছিলেন প্রাণপণে।
দ্রুতগতির বাহনটি সার্জেন্টকে ধাক্কা দিয়ে সড়ক বিভাজকের বেড়ার ওপর ফেলে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন বলে জানান সন্দ্বীপ মল্লিক।
অভিযুক্ত চালক মাসুদ রানা (২৭) রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাব্দিপুর এলাকার বাসিন্দা।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। কারণ, একদিন আগেও তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) সকালবেলা আবারও অটোরিকশা নিয়ে নগরীর রেলগেইট এলাকায় ফেরেন অভিযুক্ত সেই অটোচালক।
অভিযুক্ত চালক মাসুদ রানা
ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তাকে আটকে দেন দায়িত্বরত সার্জেন্ট রাশেদুল। জব্দ করা হয় সঙ্গে থাকা অটোরিকশার কাগজপত্র। পরে মামলা লিখতে গিয়ে দেখা গেল নথির সঙ্গে মিল নেই অটোরিকশার নম্বরটির। নম্বরপ্লেট থেকে মুছে দেয়া হয়েছে শেষের ডিজিট।
পুলিশ মাসুদকে আটক করে। এরপরই মিলে যায় পুরনো হিসেব। কিন্তু তখনও অপরাধ স্বীকার করেননি চালক। এরপর অটোরিকশাটি নেয়া হয় নগর পুলিশের ট্রাফিক শাখার দফতরে। সেখানে জেরার মুখে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান অটোচালক মাসুদ রানা।
অভিযুক্ত মাসুদের বরাত দিয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালানোর জন্য ঋণ করে অটোরিকশা কিনে সংসারের হাল ধরেন তিনি।
তিনি (মাসুদ) স্বীকার করে বলেন, তার অটোরিকশাটি সবুজ রঙের। কিন্তু রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী নগরীতে দুপুর ২টা পর্যন্ত লাল রঙের অটোরিকশা চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে তিনি জানতেন না। না জেনেই গত ২ মার্চ যাত্রী নিয়ে রামেক হাসপাতালে এসেছিলেন। রামেকে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ফের কয়েকজন যাত্রীকে তুলে রওয়ানা দেন শিরোইলের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে সোজা গোদাগাড়ী ফিরবেন।
কিন্তু সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় রেলগেইটে (শিরোইল) ঢুকতেই গাড়ি থামানোর সংকেত দেন একজন সার্জেন্ট। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ি আটকে দেবে। এতে তার সংসার চলবে না। কোনো কিছু না ভেবেই তিনি গাড়ি টান দেন বাস টার্মিনালের দিকে। সেখানে আরেক সার্জেন্ট তাকে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকেও তিনি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর ফেলে দেন।
প্রাণের ভয়ে তিনি সেদিন কোনোরকমে পালিয়ে যান। পরে কয়েকদিন বের হননি রাস্তায়। শেষে বাধ্য হয়ে নম্বর প্লেট থেকে শেষের সংখ্যাটি মুছে দিয়ে গাড়ি আবারও রাস্তায় নামান। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
সেই অটোরিকশা
চালকের ভাষ্য, তিনি বড় ভুল করে ফেলেছেন। তবুও সার্জেন্ট তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি জীবনে আর এমন ভুল করবেন না। রাস্তায় তিনি আইন মেনেই চলাচল করবেন।
সেদিনের দুর্ঘটনার ক্ষত এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের শরীর থেকে। এখনও বাম হাতে শক্তি পান না তিনি। এছাড়াও উরুর নিচে রয়েছে ২৫টি সেলাইয়ের চিহ্ন, সেখানেও রয়ে গেছে ব্যথা।
তিনি জানান, ধরা পড়ার পর তিনি গিয়ে ওই চালককে শনাক্ত করেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে তার পরিবারের দুরাবস্থার কথা জানতে পারেন। পরে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। ক্ষমা করে দেন চালককে।
সন্দ্বীপ বলেন, ওই চালক দুই শিশু কন্যার বাবা। তার নিজেও দুটি সন্তান রয়েছে। মামলা হলে তাকে কারাবাস করতে হতো। কিন্তু দুটি সন্তান, আর বিধবা মাকে নিয়ে তার স্ত্রী অনিশ্চতায় পড়তেন। তার পুরো পরিবার ভেসে যেতে পারত। বিষয়টি তাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। শেষে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন।
সার্জেন্ট সন্দীপ আরও বলেন, পুলিশ সবসময় আইনের প্রয়োগ করে। অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করে অন্যদের শিক্ষা দেয়। এই চালকের ক্ষেত্রেও এমনটি করা যেতো। যদিও চালক মানবিকতা কিংবা সহানুভূতি দেখাননি। কিন্তু তাতেও তার আক্ষেপ নেই।
সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের মানবিকতাকে সম্মান জানিয়েছেন আরএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) অনির্বাণ চাকমা। তিনি বলেন, ‘দুপক্ষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে এটি নিছকই দুর্ঘটনা। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন চালক। পরে তাকে মুচলেকা নিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। পুলিশ চায়, অপরাধীকে অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে। সেক্ষেত্রে সার্জেন্ট সন্দীপের এ ঘটনা মানবিকতার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।’
ফয়সাল আহমেদ/এসএস/এমএস