সিনেমা হলের স্থানে মাদরাসা-মার্কেট-ক্লিনিক-গোডাউন
>> ১৪ সিনেমা হলের সবকটিই বন্ধ
>> ২০১০ সালে সিনেমা ব্যবসায় ধস শুরু
>> দায়ী মানহীন ছবি, আকাশ সংস্কৃতি আর ইন্টারনেট
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় মূল সড়কের পাশের ‘ছবিঘর’সিনেমা হলটি ১০ বছর আগে ভেঙে মাদরাসা করা হয়েছে। এ উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা বাজারের ‘মিন্টুরাজ’ সিনেমা হলটি ১৫ বছর আগে ভেঙে করা হয়েছে গোডাউন। আর দর্শনার ‘দর্শন’ ও ‘হীরা’ সিনেমা হল ১০ বছর আগে ভেঙে সেখানে করা হয়েছে মার্কেট।
আলমডাঙ্গা উপজেলার পাঁচটি সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে ১৫ বছর আগে। এরমধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের ‘টকিজ’ সিনেমা হলের অবকাঠামোটি এখনো টিকে আছে। শিলা ও জনি নামের সিনেমা হল দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ বাজারের ‘রকি’ ও হাটবোয়ালিয়া বাজারের ‘শিল্পী’ সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট ও গোডাউন।
জীবননগর উপজেলার দুটি সিনেমা হলের একটিও সচল নেই। ‘আধুনিক’ সিনেমা হলটি ১৫ বছর আগে ভেঙে ক্লিনিক এবং ‘মহানগর’ সিমেনা হল ২০ বছর আগে ভেঙে মার্কেট করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদরের তিনটি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে ‘মিতালি’ সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে ১৫ বছর আগে। সেটি ভেঙে মার্কেট করা হয়েছে। আর ‘নান্টুরাজ’ এবং ‘পান্না সিনেমা (রূপছায়া)’ সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে পাঁচ বছর আগে।
জেলার ১৪ সিনেমা হলের সবগুলোই এখন বন্ধ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের বিনোদনের এ মাধ্যমটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে চুয়াডাঙ্গার সাধারণ মানুষের বিনোদনের দরজা এখন বলতে গেলে বন্ধ।
জানা গেছে, ১৯৫০ সালে দোয়ারকা দাশ আগরওয়ালা নামের এক ব্যক্তি চুয়াডাঙ্গা শহরে প্রথম ‘রূপছায়া’ সিনেমা হল নির্মাণ করেন। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘পান্না’ রাখা হয়।
পান্না সিনেমা হলের তখনকার ম্যানেজার খন্দকার আব্দুর রশিদ হীরা জাগো নিউজকে জানান, ১৯৪৯ সালে হলটির কাজ শুরু হয়। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে ‘নাগিনা’ ছবির মাধ্যমে হলের যাত্রা। তখন রাজবাড়ী, মাগুরা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও যশোরে কোনো সিনেমা হল ছিল না। এসব অঞ্চলের মধ্যে প্রথম বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) থেকে ছবি আমদানি শুরু হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো সিনেমা হল না থাকায় এখানে অনেক দর্শক আসতেন।
‘১৯৮৩ সালের পর বিশেষ করে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ মুক্তির পর বাংলা চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে। তখন প্রতিটা ছবিই ব্যয়বহুল ছিল। ব্যবসা ভালো হওয়ায় প্রায় সব জেলায় হলের সংখ্যা বেড়ে যায়।
২০১০ সালে এ ব্যবসায় ধস নামে বলে জানান খন্দকার আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আকাশ সংস্কৃতির দাপট, অনলাইনে ছবি মুক্তি, ঘরে ঘরে টেলিভিশনের সঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবের ব্যবহার, ভিসিডি ও ডিভিডি ধস নামিয়েছে হল ব্যবসায়। এক সময় রূপছায়া সিনেমা হলের কদর ছিল এলাকাজুড়ে। সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিশেষ করে ম্যানেজার, টিকিট কাউন্টার মাস্টার, রিল মাস্টার, প্রচার ম্যান, মাইক ম্যান, গেট ম্যানসহ অনেকের জীবিকা নির্বাহ হতো হলকে ঘিরে। কিন্তু বন্ধ হওয়ার পর সবাই বেকার হয়ে যায়। পরবর্তীতে সবাই অন্য পেশায় চলে গেছেন।’
স্থানীয়রা জানান, হলের পরিবেশ, রুচিসম্মত ছবির অভাব, আকাশ সংস্কৃতির দাপট আর ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসায় সিনেমা ব্যবসায় ধস নেমেছে। অথচ এক সময় এ সিনেমা হলই ছিল সীমান্তবর্তী এ জেলার মানুষের আনন্দ-বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। সেই সঙ্গে হলগুলোতে কর্মসংস্থান ছিল বহু মানুষের।
আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিজা জান্নাত জিনিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনোদন পাওয়ার উৎস ও সুযোগ নষ্ট হওয়ায় আমাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ছে। শুনেছি পারিবারিক বিনোদনের জায়গা হিসেবে একসময় সিনেমা হলের ব্যাপক কদর ছিল। কিন্তু বর্তমানে টিভি আর ডিভিডির কারণে বাড়ির বৈঠকখানাই সিনেমা হলে রূপ নিয়েছে।’
জেলার উথলী গ্রামের ওয়ালিউল্লা বলেন, ‘পরিবার নিয়ে দেখার মতো ছবি তৈরি না হওয়ায় দর্শকরা দেশীয় চলচ্চিত্র অনেকটা বর্জন করেছে। দর্শক ভারতীয় সিনেমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এখন মানুষ প্রযুক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো সময় মানুষর এখন আর নেই।’
তিনি আরও জানান, ইন্টারনেটের কারণে এখন যে কেউ চাইলে ডাউনলোড করে বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পারেন।
আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের সাহিত্যিক রহমান মুকুল বলেন, ‘বর্তমানে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ চ্যানেলগুলোতে প্রতিনিয়ত বাংলা ও হিন্দি ছবি দেখানো হচ্ছে। ফলে দর্শকরা সময় ও টাকা নষ্ট করে সিনেমা হলে যেতে চান না।’
চুয়াডাঙ্গার বিশিষ্ট ছড়াকার আহাদ আলী মোল্লা জানান, তখনকার দিনে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। অশ্লীলতার কারণে পরিবার নিয়ে হলে গিয়ে ছবি দেখার পরিবেশ না থাকায় দর্শক হলবিমুখ হয়েছে। ভালো পরিবেশ ফিরে এলে হয়তো আবারও আগের অবস্থা ফিরে আসতে পারে।
জীবননগর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি আবু মো. আব্দুল লতিফ অমল জানান, দেশে দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মত ছবির অভাব রয়েছে। এখনকার ছবি সমাজ পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নগ্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দর্শক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানের বেশিরভাগ ছবিতেই কোনো কাহিনী থাকে না। ধুম-ধারাক্কা মারপিট, অসংলগ্ন কথা ও বাজে গানে ভরা ছবি দর্শক আকর্ষণ করতে পারে না।
জীবননগরের আধুনিক সিনেমা হলের মালিক সাইফুল ইসলাম বললেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হলটি চালিয়ে আসছিলাম। কিন্তু টিভিই এখন সিনেমা হল হয়ে গেছে। দর্শক টিকিট কেটে আর হলে আসতে চায় না। ফলে সিনেমা হল ভেঙে ক্লিনিক করেছি।’
পান্না সিনেমা হলের মালিক দিলিপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘হলটি ঐতিহ্যবাহী। এ ভবনটিও বেশ প্রাচীন। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ভেঙে মাল্টিকমপ্লেক্স ও সিনেপ্লেক্স তৈরি করা হবে।’
সালাউদ্দীন কাজল/এসআর/এএসএম