প্রভাবশালীরা পানি না দেয়ায় অনাবাদী থেকে গেল ৪০ বিঘা জমি
আর মাস দেড়েক পরই শুরু হবে ফসলি জমির ধান কাটা। ধান পেকে মাঠ হয়ে উঠবে সোনালী। আশপাশের সব জমির ধান গাছ বড় হতে শুরু করেছে। চোখের সামনে অন্য কৃষকের জমির ধানকাটা দেখলেও এবার নিজের জমিতে ফসল ফলাতে পারেননি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় বৃদ্ধ কৃষক ইউনুছ মিয়া।
প্রভাবশালীদের দাপটে ৪০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে পারেননি এই বৃদ্ধ। এসব জমি থেকে প্রতি বছর প্রায় ১২শ মণ ধান উৎপাদন হত।
উপজেলার পত্তন ইউনিয়নে আতকাপাড়ার এই ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দেয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা টালবাহানা শুরু করেন। অভিযোগের প্রায় দুইমাস পর তদন্তে আসে কৃষি অফিসের দল। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করছেন।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মনিপুর গ্রামের আতকাপাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ ইউনুছ মিয়া পেশায় একজন কৃষক। তার ছেলে লিলু মিয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী। তিতাস নদীর ওপর দিয়ে বিজয়নগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সীমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশের হাইখোলা মৌজায় ছয়টি বিএস দাগে ২৯৩ শতক ও ক্রয়সূত্রে দলিলমূলে আরও কিছু নাল জমির মালিক লিলু মিয়া। তিনি এসব জমি স্থানীয় কৃষকদের কাছে বর্গা দিয়ে রেখেছেন। জমিগুলোর দেখভাল করেন লিলুর বাবা ইউনুছ মিয়া।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর দেশে আসেন লিলু। পরবর্তীতে আবারও আমিরাতে ফিরে যান তিনি। কিন্তু দেশে থাকার সময় পাশের গ্রামের এক ব্যক্তির সাথে কথা কাটাকাটি জেরে হৃদয় আহমেদ জালালের উসকানিতে লিলু মিয়ার লোকজনের ওপর হামলা হয়।
এরই জেরে লিলু মিয়ার মালিকানাধীন প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে সেচের মেশিন থেকে পানি দেননি জালাল। ফলে ওই জমিগুলো অনাবাদি রয়ে গেছে। এতে করে লিলু মিয়ার বাবার কাছ থেকে জমি বর্গা নেয়া প্রায় ২০টি পরিবার ১২শ মণ ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গত ২৫ জানুয়ারি লিলু মিয়ার বাবা ইউনুছ মিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে মনিপুর গ্রামের প্রভাবশালী ১০ জনের নাম উল্লেখ করে সমস্যা নিরসনের দাবি জানান। ওই অভিযোগের তদন্তভার দেওয়া হয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খিজির আহমেদকে। তদন্তের দায়িত্ব দেয়ার প্রায় দুইমাস পর সংবাদকর্মীরা বিষয়টি জেনে যাওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে ঘটনাস্থলে লোক পাঠান।
এ বিষয়ে ইউনুছ মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার জমি বছরে একবার চাষ করা যায়। বাকি সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। আশপাশের সব জমিতে পানি দিলেও জালাল এ বছর আমাদের জমি চাষের সময় পানি দেয়নি। থানায় বিষয়টি জানালে নামকাওয়াস্তে সে পানি দিতে রাজি হয়। কিন্তু তখন আশপাশের সকল জমি চাষ করা হয়ে গেছে। সেসময় পানি দিয়ে কী হবে, যদি হালচাষ ও ধানের চারা রোপণ করাই না যায়?
তিনি আরও বলেন, এই এলাকার প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৩০/৩৫ মণ ধান উৎপাদন হয়। সেই অনুযায়ী ১২শ মণ ধান উৎপাদন না করায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ থেকে ১২ লাখ টাকার।
লিলু মিয়ার ফুফাতো ভাই ফারুক মিয়া বলেন, কৃষিজমিতে সেচের পানি দিতে হৃদয় আহমেদ জালাল ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অনেকগুলো মেশিন রয়েছে। তারা এই বছর অন্য কৃষকদের জমিতে পানি দিলেও আমার ফুফার কোনো জমিতে পানি দেয়নি। এর ফলে জমিগুলো অনাবাদি রয়ে গেছে। বর্গাচাষীরা এবার ধানচাষ করতে পারেনি।
জয়নাল মিয়া, জোহরা বেগম, কাজল বেগম, তাজু মিয়াসহ কয়েকজন বর্গাচাষী বলেন, এবছর যখন আমরা ধান চাষ করতে জমিতে আসি, তখন জালাল মিয়া চাষ করতে নিষেধ করেছে। জালাল জানায় সে চাষের পানি দিবে না। এর ফলে এবছর জমিতে ধান চাষ করতে পারেননি তারা।
অভিযুক্ত হৃদয় আহমেদ জালালের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে তার ছেলে জাহিদ আহমেদ জয় বলেন, স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য সেলিম মিয়ার সঙ্গে লিলু মিয়ার ঝগড়া হয়। সেই ঘটনায় তারা আমাদের নামে একাধিক মামলা দিয়েছে। তবে তদন্তে কোনো মামলাই টেকেনি। আমরা সেচের পানি দিয়েছিলাম। তারা নিতে চায়নি। কেন নেয়নি সেটা জানি না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খিজির আহম্মেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি এলাকার লোকজনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করেছি।
তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহী নন।
জেলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক রবিউল হক মজুমদার বলেন, সেচ কাজে পানি দিতে বাধা দেওয়া একটি মারাত্মক জঘন্যতম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বছর সময় পেরিয়ে গেলেও আগামী মৌসুমে যেন এমনটা না হয় সে ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কেএম ইয়াসির আরাফাত বলেন, সেচের পানি না দেয়ার অভিযোগটি পেয়েছি। জমিতে পানি দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।
এফএ/জিকেএস