বিস্তৃত পরিচিতির পরও ভাসানীর কাছে বিনয়ী ছিলেন বঙ্গবন্ধু

আরিফ উর রহমান টগর
আরিফ উর রহমান টগর আরিফ উর রহমান টগর টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ০৯:১৯ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২১

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিনয় আর নম্রতা আমার মনে দাগ কেটে আছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী নেতায় পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। তবে এসময়কালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিমাপের বিস্তৃতি ঘটলেও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হুজুরের সামনে সেই বড়ত্ব দেখাননি তিনি। আমার ধারণা, দৈহিকভাবে যেমন বড় ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি ছিলেন আত্মিকভাবেও বড়।’

‘১৯৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত একক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাসানী হুজুরের জন্য উদার আর নিবেদিত। ভাসানী হুজুরকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন তিনি। তাদের সর্ম্পক ছিল পিতা-পুত্রের মতোই আত্মিক। যা তাদের আচার-আচরণ আর কথাবার্তায় আমি স্পষ্টভাবে বুঝেছি। পাশাপাশি খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই বিনয় আর নম্রতা দেখার সুযোগও হয়েছে আমার।’

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একান্ত সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসানী স্টাডিজের কোর্স টিচার এবং মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত সাবেক সচিব সৈয়দ ইরফানুল বারী (৭৬)।jagonews24আন্দোলন-সংগ্রামে একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

কিশোরগঞ্জ পৌর শহরের হয়বত নগরের মরহুম সৈয়দ ফজলুল হকের ছেলে সৈয়দ ইরফানুল বারী। ১৯৬৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে মওলানা ভাসানীর সংস্পর্শে থাকলেও ১৯৮১ সাল থেকে বাসাবাড়ি করে সন্তোষে (টাঙ্গাইলের এলাকা, এখানে মওলানা ভাসানীর জীবনের একাংশ কেটেছে) বসবাস করছেন তিনি।

ইরফানুল বারী বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় ভাসানী হুজুর তাকে মুক্ত করতে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তান সরকার আন্দোলনে আতঙ্কিত হয়ে ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়ে ওইদিনই প্রথম ভাসানী হুজুরের সঙ্গে ঢাকার ইস্কাটন রোডে দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন, ভাসানী হুজুরের সৃষ্ট আন্দোলনের ভয়েই পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি সেখানে গিয়ে হুজুরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন।’

‘তার (বঙ্গবন্ধু) আচরণটা ছিল হুজুর যেখানে আর যে অবস্থাতেই থাকুন, তিনিই তার নেতা আর সেখানেই তার দেখা করা উচিত। এ কারণে তিনি সন্তোষে না এসে ঢাকায় হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন।’jagonews24সৈয়দ ইরফানুল বারীর লেখা বই ‘ভাসানী সমীপে নিবেদন ইতি’

মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত সাবেক এই সচিব আরও বলেন, ‘কংগ্রেস নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলীর শিষ্য ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ওই নেতার বাড়িতে থাকতেন বলে তার মাকে মা ডাকতেন হুজুরও। নেতার স্বীকৃতি আর দায়বদ্ধতাস্বরূপ ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে কংগ্রেস নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলীর নামে এম.এম আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন মওলানা ভাসানী।’

‘ওই বছরই সন্তোষে ৬ দিন ও ৬ রাতব্যাপী হয় কাগমারী সম্মেলন। সম্মেলনে আসা লাখ লাখ মানুষের খাওয়ার চাল সংগ্রহ করেন ভাসানী হুজুরের আধ্যাত্মিক শিষ্যরা। সম্মেলন শেষে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট প্রায় আঠারশ’ মণ চাল বিক্রি করে স্থাপিত ওই কলেজের ফান্ড জোগাড় করেন হুজুর। বাংলাদেশ আমলে হুজুরের প্রতিষ্ঠিত কলেজের ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় শিক্ষকের বেতন দেয়া নিয়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এ কারণে হুজুর বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লেখেন—তুমি আসো এবং আমার প্রতিষ্ঠিত কলেজটি সরকারিকরণ করো।’

হুজুরের এক চিঠি পেয়েই সরকারিকরণে সকল প্রক্রিয়া করে দেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এম.এম আলী কলেজকে সরকারিকরণের ঘোষণা দেয়।

এই সরকারিকরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে বঙ্গবন্ধুকে আরেকটি চিঠি দেন মওলানা ভাসানী। সেখানে লেখেন, ‘তুমি নিজে এসে এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যাও, আর তুমি যদি না আসো তাহলে আমি আমার প্রতিষ্ঠিত কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে যাব না।’

jagonews24সৈয়দ ইরফানুল বারী

সৈয়দ ইরফানুল বারী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ভাসানী, কিন্তু আমি না গেলে তিনি সেই ভিত্তিপ্রস্তুর অনুষ্ঠানে যাবেন না—এটা হুজুরের অভিমানের কথা, সেটি বুঝে যান বঙ্গবন্ধু। হুজুরের অভিমানে বিচলিত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু আর চিঠির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে তিনি থাকবেন বলেও জানান।’

‘৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজে এসে ও ভাসানী হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে কলেজটির সরকারিকরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলকে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতিতে লেখা হয়—“মাননীয় রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। ওই লেখা নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা। কথা ওঠে অনুষ্ঠানে হুজুর থাকবেন আর সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতিতে লেখা থাকবে ‘জাতির জনক’, সেটা হুজুর কিভাবে নেবেন? এ কথা হুজুরের কানে আসে। তিনি তৎকালীন কলেজের দায়িত্বরত প্রিন্সিপাল আর ডেপুটি কমিশনারকে খুব বকাবকি করেন। হুজুর বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক তো হয়েই আছে, সেটি লেখায় দোষ কী? আমি নির্দেশ দিলাম—ওই ভিত্তিপ্রস্তুরে মাননীয় রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা থাকবে”।’

‘১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ “বঙ্গবন্ধু জাতির জনক” সেটি শুধু মুখে বলেই নয়, কলেজের সরকারিকরণের ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলকের মাধ্যমেই স্বীকৃতি দিয়েছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’—যোগ করেন ইরফানুল বারী।

jagonews24মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর শয্যাপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৬৯-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মওলানা ভাসানীকে লেখা সংগৃহীত চিঠিপত্রের অংশবিশেষ নিয়ে ইরফানুল বারী ‘ভাসানী সমীপে নিবেদন ইতি’ নামে একটি বই লেখেন। ওই বইয়ের ১১৪ আর ১১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের ২১ মার্চ আর ১৯৭৪ সালের ১৭ আগস্ট নিজ হাতে লেখা চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে ইরফানুল বারী বলেন, ‘এসময় বঙ্গবন্ধু শুধু দেশের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, ছিলেন এক ও একক ক্ষমতার অধিকারী। চিঠি লেখার জন্য তার ছিল ব্যক্তিগত স্টেনোগ্রাফার ছিল। তারপরও হুজুরকে নিজ হস্তে চিঠি লিখেছেন তিনি। দিয়েছেন আর্থিক সহায়তাসহ সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। তার কাছ থেকে নিতেন রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্তও।’

মওলানা ভাসানীর সাবেক এই ব্যক্তিগত সচিব বলেন, ‘১৯৪৭ সালে আসামের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতাভিত্তিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ঘিরে প্রগতিশীল মুসলিম লীগের একজন নেতা। সেই পরিচয় নিয়ে সিলেট জেলাকে পূর্ব বাংলায় অন্তর্ভুক্ত রাখার কর্মসূচিভিত্তিক সিলেট রেফারেন্ডামে একমত ছিলেন দুই নেতাই। অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য ভোটিং কার্যক্রমে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছেন ভাসানী আর বঙ্গবন্ধু।’

jagonews24আন্দোলন-সংগ্রামে একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

‘১৯৪৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরাসরি তার নেতা না হলেও ‘হুজুর’ বলেই ডেকেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৩ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াসহ বিস্তৃত রাজনৈতিক পরিচিতি লাভ করার পরও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি ভাসানী হুজুরের কাছে বিনয়ী। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই ডাকটিই (হুজুর) বহাল রাখেন বঙ্গবন্ধু’—স্মৃতি হাতড়ে বলতে থাকেন সৈয়দ ইরফানুল বারী।

আরিফ উর রহমান টগর/এসআর/এইচএ/এমকেএইচ

হুজুর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক তো হয়েই আছে, সেটি লেখায় দোষ কী? আমি নির্দেশ দিলাম—ওই ভিত্তিপ্রস্তুরে মাননীয় রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা থাকবে’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।