চোখে ‘শর্ষে ফুল’ দেখা সাজেদাই এখন সফল ফুলচাষি
‘আত্মহত্যা করার দরকার নেই; মন খারাপ হলে ফুল বাগানে আসুন, মন ভালো হয়ে যাবে।’ হতাশাগ্রস্তদের মন ভালো করার জন্য এমন ভিন্নধর্মী আহ্বান জানান যশোরের গদখালী এলাকার সফল নারী ফুলচাষি সাজেদা বেগম।
দুর্ঘটনায় স্বামী ইমামুল হক শয্যাশায়ী হওয়ার পর চোখে ‘শর্ষে ফুল’ দেখা সাজেদার চোখ এখন দেখে হরেক ফুলের হাসি। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে গ্লাডিওলাস ফুলের বীজ পিঁয়াজ বলে ভুল করা সাজেদা এখন বিঘা বিঘা জমিতে ফুলের চাষ করেন। চাষ করেন জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদাসহ নানা ফুল। দুর্বিপাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এই নারী তার সংগ্রামের জন্য পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কারও।
সাতক্ষীরা পৌরসভার পারকুকরালি এলাকার মেয়ে সাজেদা বেগমের বিয়ে হয় ষোলতেই। পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়া হয়নি। স্বামী ইমামুল হকের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এলাকার হাড়িয়া গ্রামে। ইমামুল তখন কয়েক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গোলাপের চাষ করেন। এসব ১৯৯৭-৯৮ সালের ঘটনা।
সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাজেদা বেগম বলেন, ‘আমার বাবার বাড়ির এলাকায় ধান, পাট, মাছ চাষ হয়। ফুলচাষ তেমন দেখিনি। স্বামীর বাড়িতে উঠানে রাখা গ্লাডিওলাস ফুলের বীজকে পিঁয়াজ ভেবে ভুল করেছিলাম। ফুল চাষ তেমন বুঝতাম না। স্বামীর সাথে মাঝে মধ্যে মাঠে গিয়ে চাষবাস দেখেছি। অল্প অল্প করে বুঝেছি। সেটি শুধুই দেখে দেখে সামান্য শেখা।’
ওই সময় ভালোই চলছিল সাজেদার সংসার। কিন্তু হঠাৎ করেই অমানিশা নেমে আসে তাদের জীবনে। ২০০৪ সালে শিরিষ গাছ থেকে পড়ে যান সাজেদার স্বামী ইমামুল হক। কোমর এবং মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত পান। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি।
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় একদিকে যেমন উপার্জন বন্ধ, অন্যদিকে তার চিকিৎসা ব্যয়। চোখে যেন সরষে ফুল দেখতে শুরু করেন সাজেদা। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তিনি।
স্বামীর ফুলক্ষেতের হাল ধরেন তিনি। ফুল বিক্রি ও চাষ শুরু করেন। ঢাকার ব্যাপারীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তারে এসে ক্ষেত থেকেই ফুল কিনে নিয়ে যান। ধীরে ধীরে ফুলচাষের পুরো প্রক্রিয়াটি আয়ত্ব করেন। দু’বছরে স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় হয় ৮-৯ লাখ টাকা। স্বামী সুস্থ হলেও পুরো কর্মক্ষমতা তার ফিরে আসেনি। এখনও ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন।
সেই দুর্যোগপূর্ণ সময়ের কথা স্মরণ করে সাজেদা বলেন, ‘আমার তখন বৌ-কাল, অল্প বয়স। নানা ভয়, দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক কাজ করত। ফুলের ক্ষেত বাড়ি থেকে দূরে। রাত-বিরাতে সেখানে যাওয়া যায় না। সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভয় করত। শাড়ি পরি। সালোয়ার-কামিজ বা জামা পরি না। শাড়ি পরে গোলাপ বাগানে ঢোকা যায় না। কাঁটায় শাড়ি ছিঁড়ে যায়। গোলাপ চাষ বাদ দিলাম।’
গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধার পর শুরু করি জারবেরা চাষ। বাড়ি থেকে দূরের জমি ছেড়ে দিয়ে কাছাকাছি ১০ কাঠা জমিতে প্রথম জারবেরা চাষ করি। সাফল্য আসার পর বাড়তে থাকে চাষের পরিধি। এখন সাড়ে চার বিঘা জমিতে জারবেরাসহ অন্যান্য ফুলের চাষ করছি।
দুর্দিন পেছনে ফেলে আসার কথা তুলে ধরে সাজেদা বলেন, স্বামী দুর্ঘটনার আগে বাড়ি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার পর তা থমকে যায়। এখন সেই ভিটায় একতলা বাড়ি হয়েছে। বড় মেয়ে অনার্স পড়ছে, ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
করোনা মহামারি এবং আম্পানে অনেক ক্ষতি করেছে উল্লেখ করে সাজেদা জানান, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় লকডাউনসহ নানা কারণে ফুল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে মে মাসে হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানে ফুলক্ষেতের শেড লন্ডভন্ড হয়ে যায়। করোনাভাইরাস ও আম্পানের ক্ষতি এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। আম্পানে ভেঙে পড়া শেডগুলো মেরামত করতে হলে অনেক টাকা দরকার। ব্যাংক ঋণ, এনজিও’র লোন এসব দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
সাজেদা বেগমের স্বামী ইমামুল হক বলেন, দুর্ঘটনায় তিনি শয্যাশায়ী হওয়ার পর স্ত্রী সাজেদা হাল ধরেন। ফুলচাষকে ধরে রেখে তার চিকিৎসা হয়েছে। এখন সে নিজ হাতে ফুলচাষের সব কাজ করেন। অসুস্থ শরীরে তিনি যতটুকু পারেন সহযোগিতা করেন।
সাজেদা জানান, ফুল চাষ করে সুদিন ফিরিয়ে আনার সংগ্রামের জন্য তিনি কয়েকটি সম্মাননাও পেয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর ঝিকরগাছা উপজেলা প্রশাসন ‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ হিসেবে জয়িতা সম্মাননা এবং বিবর্তন যশোর ‘সোনার দেশের সোনার মানুষ’ সম্মাননা দিয়েছে।
জারবেরা ফুল উৎপাদনে ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি দিয়েছে অভিনন্দন স্মারক। এর আগে ২০১৫ সালে ভারতের হায়দরাবাদে ‘ফুল চাষে বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তা কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণেও অংশ নেন তিনি।
সাজেদা জানান, বাংলাদেশে ফুলচাষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফুল রফতানি করা দরকার। কিন্তু তার পরিবর্তে দেশেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চায়না প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার হচ্ছে। এ সঙ্কট দূর না হলে ফুল চাষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এছাড়া করোনা ও আম্পানের কারণে ক্ষতির শিকার ফুলচাষিদের সুরক্ষায় স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণ ও সহযোগিতা দরকার।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, গদখালী এলাকায় ফুলচাষে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সাজেদা বেগম ভালো করছেন। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটিও তাকে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে। এছাড়া তিনি আরও কয়েকটি সম্মাননা পেয়েছেন। ফ্লাওয়ার সোসাইটির সহযোগিতায় তিনি ভারতে উন্নত প্রশিক্ষণও পেয়েছেন।
মিলন রহমান/এফএ/জেআইএম