ব্রিটিশ নৃশংসতার সাক্ষী ঝালকাঠির কুলকাঠি
উপমহাদেশের হৃদয় বিদারক ও কলঙ্কময় কুলকাঠি হত্যাযজ্ঞ দিবস আজ (০২ মার্চ)। ব্রিটিশ শাসনামলের এ ঘটনা ‘দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ নামেও পরিচিত।
১৯২৭ সালে (বাংলা ১৩৩৩ সালের ১৮ ফাল্গুন) এ দিনে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই এন ব্লান্ডির হুকুমে গুর্খা সৈন্যদের গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঝালকাঠির কুলকাঠি এলাকায় ১৯ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। এসময় আহত হন অসংখ্য মুসলিম জনতা।
বেদনাময় এ দিনটি পালনের জন্য প্রতিবছরের মত এবারেও কুলকাঠি মসজিদ কমিটির উদ্যোগে স্মরণসভা, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল এবং বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
ঝালকাঠি শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ও নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি দুটি ইউনিয়ন ছিল ঘটনাস্থল। সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক ৫২টি ধর্মীয় স্থানের মধ্যে তৃতীয় তীর্থস্থান শিববাড়ির অবস্থান।
প্রাচীনকাল থেকে প্রতি বছর শিবচতুদর্শী উপলক্ষে শিববাড়িতে বিরাট মেলা বসে। এখন এই মেলা দুই-তিনদিনে সীমাবদ্ধ হলেও আগে পক্ষকাল থেকে মাসব্যাপী মেলা চলতো।
শিববাড়ির কাছেই জেলার নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি গ্রামটি অবস্থিত। ইংরেজ আমলে ১৯২৬ সালে এ গ্রামে একটি জামে মসজিদ নির্মিত হয়। হিন্দুরা ঢোলবাদ্য বাজিয়ে মসজিদসংলগ্ন রাস্তা দিয়েই মেলায় যাতায়াত করায় মুসলমানদের ইবাদতে সমস্যা হতো। এ নিয়ে মসজিদের ইমাম মৌলভী সৈয়দ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসল্লিরা হিন্দু নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেও ব্যর্থ হন।
এ অবস্থায় মুসলমানগণ মসজিদের পাশে রাস্তা দিয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে যেতে না দেয়া এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা বাজনা সহকারেই শিবমন্দিরে যাবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে। খবর পেয়ে বিখ্যাত হিন্দুনেতা সতীশ সেন একদল ‘হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক’ নিয়ে শিববাড়ি-কুলকাঠি এলাকায় অবস্থান নেন। শান্তিভঙের আশঙ্কায় বাকেরগঞ্জের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই এন ব্লান্ডি, পুলিশ সুপার মি. টেলর এবং সদর এসডিও জি কে বিশ্বাস গুর্খা বাহিনী নিয়ে কুলকাঠি আসেন।
দু’পক্ষের বিরোধের একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি মুসলমানদের ওপর গুলি করার জন্য গুর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৯ মুসল্লি আর আহত হন অনেকেই। পরে শহীদদের স্বজনরা গ্রামে এনে মসজিদের কাছে দাফন করেন তাদের।
সেই বীর শহীদরা হলেন- বাবর উল্লাহ হাওলাদার, আফেল গাজী, নঈম উদ্দিন হাওলাদার, এয়াসিন আকন, আতামুদ্দিন হাওলাদার, হাসান উল্লাহ হাওলাদার, মোসলেম উদ্দিন, মোহন মোল্লা, সেরাজ উদ্দিন, সুন্দর খান, ছবদার খান, মফেজ হাওলাদার, রহমালি হাওলাদার, বলু খান, রিয়াজ উদ্দিন, জাহের তালুকদার, জহির উদ্দিন হাওলাদার, আবুল হোসেন হাওলাদার ও ফরমান উল্লাহ।
তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ করা হয়। মাসিক সওগাত পত্রিকা ঘটনাটিকে ‘দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
খবর পেয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কুলকাঠিতে ছুটে এসে এক জনসভা করেন। হত্যাকাণ্ডের হোতা ব্লান্ডিকে ‘ব্লাডি’ বলে আখ্যায়িত করেন। নরহত্যার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
সরকার পক্ষ মামলায় হেরে গেলে প্রত্যেক শহীদ পরিবারের জন্য ভোলা জেলার চরমোয়াজানে দশ কানি জমির বরাদ্দ দেয়া হয়। কবরস্থানের চারদিকে দেয়াল এবং মসজিদটি ভালোভাবে নির্মাণ করে দেয়া হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি ক্ষমা প্রার্থনাও করে।
১৯ শহীদের স্মৃতিরক্ষা কুলকাঠির চন্ডিপ্রসাদ হাইস্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘কুলকাঠি শহীদিয়া ইউনিয়ন একাডেমি’। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে কুলকাঠির শহীদদের স্মৃতি আজ বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ১৯ শহীদের কবর। স্থানীয়ভাবে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বিদেশি অর্থে মসজিদের কিছু উন্নয়নও হয়েছে।
তবে ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিময় স্থাপনাগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও সংষ্কারের জন্য সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এত বড় ঘটনা কালের স্বাক্ষী হিসেবে থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা অজানাই থেকে যাচ্ছে।
আতিকুর রহমান/এসএমএম/জেআইএম