পালকিতে আর চড়ে না কনেরা

নূর মোহাম্মদ
নূর মোহাম্মদ নূর মোহাম্মদ কিশোরগঞ্জ
প্রকাশিত: ১১:২৭ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদী তীরের কারপাশা রবিদাস পল্লীর সুবল রবিদাসের পূর্বপুরুষদের জীবন কেটেছে পালকির বেহারার পেশায়। এক সময় তাদের পল্লীতে শত শত পালকি ছিল। বিয়ে বা অন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান হলে কিংবা শহরের বাবুরা বেড়াতে এলে ডাক পড়ত তাদের। কিন্তু এসব এখন কেবলই স্মৃতি!

পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রাখলেও আগের সেই জৌলুস এখন নেই। তাইতো পুরনো এ কাঠের পালকির মতোই জীর্ণতার দোলাচলে বইছে তার জীবন সংসার।

ভূপেন হাজারিকার জীবনমুখি গানে উল্লেখ করা পালকির বেহারাদের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! পালি ভাষায় পলাঙ্কো। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় পালকি। রামায়নে উল্লেখ করা হয়েছে মানুষ ভেতরে রেখে অন্যমানুষেরা কাঁধে করে বহন করা কাঠের তৈরি এই পালকির কথা। পালকির বাহকদের বলা হয় বেহারা। প্রাচীন এ বাহনটির সঙ্গে মিশে আছে বাংলার অতীত-ঐতিহ্য আর নানা লোকগাঁথা।

পারস্য পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণে পালকি ব্যবহার করতেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সেনাধ্যক্ষদের প্রধান বাহন ছিল পালকি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে থাকার সময় জমিদারি কাচারি পরিদর্শনে যেতেন পালকিতে চড়ে।

মূলত প্রাচীন কাল থেকে পালকির ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পালকির ব্যবহার কমে যাওয়ায় চরম দুর্দিনে বংশ পরম্পরায় এ পেশায় জড়িত রবিদাস সম্প্রদায়ের এসব বেহারারা। খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটছে তাদের।

সমাজের চোখে চরম অবহেলিত ও নিচু বর্ণের এসব মানুষেরা কীভাবে বেঁচে আছেন আর কীভাবে কাটছে তাদের জীবন সেই খবর এখন আর কেউ রাখে না।

কারপাশা উজানহাটি গ্রামের ছোট্ট এ রবিদাস পল্লীতে বৃটিশ আমল থেকেই স্থাণীয়ভাবে, মুচি, হিসেবে পরিচিত রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে আসছেন। মূলত পালকির বেহারাই ছিল তাদের পেশা। বর্তমানে এ পল্লীতে কোনোভাবে টিকে আছে ১০টি পরিবারের ৩৫ জন মানুষ। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

চরম অনমানবিক পরিস্থিতিতে খেয়ে না খেয়ে চলছে তাদের জীবন। অনেকেরই স্বামী নেই। তবুও মিলছে না সরকারের বিধবা ভাতা কিংবা ভিজিডি কার্ড সুবিধা। পুরো এলাকায় হাতেগোণা কয়েকটি পালকি থাকলেও ভাড়া হয় কালেভদ্রে।

জুতা সেলাই আর সেলুনে চুল কেটে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা এখানকার পুরুষদের। আর নারীরা মাটি কেটে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন। জেলার ১৩টি উপজেলাতেই একই চিত্র রবিদাস সম্প্রদায়ের পালকির বেহারাদের।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলায় সব মিলে দুইশর মতো রবিদাস সম্প্রদায়ের পরিবারের বাস। এর মধ্যে পালকির বেহারার পেশায় এখনও টিকে আছে কয়েক উপজেলার ১০টির মতো পরিবার।

দেশের সব মানুষের সামগ্রিক জীবনমানের উন্নতি হলেও চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা এসব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সরকারের নেই উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।

তবে পালকির বেহারা বা রবিদাস সম্প্রদায়ের সার্বিক সহযোগিতার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের জন্য নতুন কিছু করার চিন্তা চলছে বলে জানালেন জেলা পরিষদের চেয়ারমান অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান।

বাঙালির আদি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম অনুসঙ্গ এ পালকিকে সীমিত পরিসরে হলেও টিকিয়ে রাখা এবং বেহারাদের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হবে এমনটাই মনে করছেন এ পেশায় জড়িতরা।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।