চার ইঁদুরে ভাগ্য বদল মামুনের
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ বিবেকানন্দের সেই কথার সাথে মিল রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাব সহকারী সালাউদ্দিন মামুনের। কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে যেকোনো প্রাণির প্রতি রয়েছে তার অসম্ভব ভালোবাসা। নিজ এলাকাতেও তিনি পশুপ্রেমী মামুন নামে বেশ সুপরিচিত।
সালাউদ্দীন মামুনের জীবপ্রেমের আরেক উদাহরণ মেলে রাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। যার মাধ্যমে তিনি রাজশাহীতে আত্মপ্রকাশ করেন এক ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তা হিসেবে। এখন তাকে পুশুপ্রেমী মামুন নামের চাইতে ‘ইঁদুরচাষি মামুন’ নামেই বেশি চেনে মানুষ।
ঘটনাটি ২০১৭ সালের নভেম্বরের শেষ দিকের। মামুন ও তার সহকর্মী মাসুদ একসাথে ল্যাবের সামনে বসেছিলেন। এ সময় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এক পিএইচডি গবেষক মাসুদকে সুইস অ্যালবেনো ইঁদুরের চারটি বাচ্চা দিয়ে সেগুলোকে ছেড়ে দিতে বলেন।
ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দেখে বড্ড মায়া হয় মামুনের। ভাবলেন কিছুদিন রেখে বড় হলে ছেড়ে দিলে হয়তবা তারা বেঁচে যাবে। অন্যথায় হিংস্র বন্যপ্রাণির আক্রমণে মারা যাবে তারা। এই ভেবে মায়া ও সখের বসে বাচ্চাগুলো নিয়ে আসেন বাসায়। একটি জুতার বক্সে কাপড় বিছিয়ে ইঁদুরগুলোর থাকার ব্যবস্থাও করেন তিনি।
প্রথমদিকে ইঁদুরের পরিচর্যা সম্পর্কে বিন্দু মাত্র ধারণা ছিল না মামুনের। ইঁদুরগুলোকে খেতে দিতেন চাল ও গম জাতীয় খাবার। পরে ইউটিউব দেখে জেনে নেন সুইস অ্যালবিনো ইঁদুরের পরিচর্যা।
মাসখানেক পর ইঁদুরগুলো থেকে বাচ্চা পান। বাচ্চাগুলো বড় হলে ২০টি বাচ্চা রাবির এক শিক্ষক কিনে নেন তার গবেষণার কাজে। এই অপ্রত্যাশীত লাভ দেখে হতবাক হন মামুন। দেখেন সম্ভাবনার নতুন দ্বার।
জীবের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এমনটা ঘটেছিল মামুনের সাথে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ফার্মাসিটিক্যালস ল্যাব থেকে অর্ডার পান। জীবনে আসে নতুন মোড়। ওই চারটি ইঁদুরেই ভাগ্য বদল হয় মামুনের।
অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রমী ব্যবসা শুরুর বিষয়ে মামুন জানান, নিয়মিত পরিচর্যায় ২৮ দিন পর একটি ইঁদুর ১০টি বাচ্চা দেয়। রাতে বাচ্চাগুলোকে দেখতে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখি মা ইঁদুর তার বাচ্চাগুলোকে দুধ খাওয়াচ্ছে। এতে বেশ আশ্চর্য ও হতবাক হয়ে পড়ি। তার এক সপ্তাহ পর আরও একটি ইঁদুর ১০টি বাচ্চা দেয়। এসব ঘটনা দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত ও আনন্দ আসে মনে। উচ্ছ্বাস ও আনন্দ নিয়ে বিষয়টি আমার বিভাগের শিক্ষক ও স্টাফদের গিয়ে শোনাই। এতে মোটামুটি ক্যাম্পাসে সবাই জানতে পারে আমার সুইস অ্যালবিনো ইঁদুর পালনের বিষয়টি।
সখ থেকে ইঁদুরের খামারি হয়ে ওঠার বিষয়ে মামুন বলেন, ক্যাম্পাসে এরই মধ্যে জামার্নির এক গবেষক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। তার গবেষণার জন্য আমার কাছে ইঁদুরগুলো চাইলেন। গবেষণায় ইঁদুরগুলো মারা যাবে বলে প্রথমে দিতে রাজি হইনি। পরবর্তীতে মিউজিয়ামের কিউরেটর আঞ্জুম আরা আমাকে বুঝিয়ে বললেন। বিষয়টি বোঝার পর তাকে ২০টি ইঁদুর দিই। তিনি আমাকে ১ হাজার টাকা দিলেন। টাকা পেয়ে আমি কিছুটা অবাক হই।
কিছুদিন পর রাজশাহী জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবু রেজা ফোন করেন ২০টি ইঁদুর নেয়ার জন্য। দর দাম না জানাই স্যারকে ইচ্ছে মতন টাকা দিতে বলি। ইঁদুর প্রতি ৪০ টাকাসহ অতিরিক্ত মোট ১ হাজার টাকা দেন। এটিই ছিল তার প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর বিক্রি। এরপরই মূলত ইঁদুর পালনে আগ্রহী হয়ে উঠি। যদিও প্রথম পাওয়া টাকাগুলো স্টাফদের নাস্তা করিয়ে দিয়েছিলাম।
মামুন জানান, মূলত অধ্যাপক আবু রেজা আমাকে পরামর্শ দেন সেগুলোর ভালোভাবে যত্ন নেওয়ার এবং সেই সাথে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার। সুইস অ্যালবিনোর বাণিজ্যিক চাহিদা ও ঘাটতির বিষয়টি তার কাছে শোনার পর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এরপর আরও নীবিড়ভাবে পরিচর্যায় মনোযোগ দেন তিনি। মামুন এখন তার নিজ বাড়িতেই একটি গরুর গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে ইঁদুর পালন করছেন। সেই জায়গাতে ইঁদুরগুলো থাকছে স্বাধীনভাবে।
তিনি বলেন, বর্ষায় একবার গোখরা সাপ ঢুকে খেয়ে ফেলে বেশ কিছু ইঁদুর। তাই সাপ, বেজি, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে রক্ষা করতে কক্ষের চারদিকে নেট লাগানো হয়েছে।
ইঁদুরের পরিচর্যা ও পালনের বিষয়ে মামুন বলেন, বর্তমানে তার খামারে রয়েছে মোট ১৪০টি ইঁদুর। তার মধ্যে ৬০টি নারী ইঁদুর, ৪০টি নর ইঁদুর এবং ৪০টি বাচ্চা ইঁদুর। প্রত্যেকটি স্ত্রী ইঁদুর এক থেকে দেড় মাস পরপর ৮-১০টি বাচ্চা দেয়। সর্বোচ্চ ১৪টি করেও বাচ্চা দেয়। খাবার হিসেবে ইঁদুরগুলোকে নিয়মিত চাল, গম, ভূট্টা, ডালসহ পল্ট্রি ফিড জাতীয় খাবার দিচ্ছেন।
১০০টি ইঁদুরের জন্য মাসে খাবার খরচ পড়ে প্রায় হাজার তিনেক টাকা। সেই সাথে প্রয়োজন পড়ে বাক্স, কাগজ, কাঠের গুড়া ইত্যাদির। দু’একদিন পর পর পরিষ্কার করতে হয় তাদের আবাস। তবে এই ইঁদুরের জন্য ২৪ ঘণ্টা বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন পড়ে। যা তাদের সরবরাহ করা হয় মুরগির পল্ট্রিফিডের পানির জারের মাধ্যমে।
মামুন জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ইঁদুর বিক্রি করেছেন। ৩ বছর আগে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করতেন, কিছুদিন আগে নিতেন ৭০ টাকা। তবে বর্তমানে ১০০ টাকা করে বিক্রি করছেন। শুরুর দিকে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জন্য ইঁদুর কিনতেন। এখন রাবি ছাড়াও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার একাধিক ফার্মাসিউটিক্যালস ও গবেষণাগার থেকে ইঁদুর নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোন পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, দিনে গড়ে ৩টি ফোন আসে ইঁদুর কেনার জন্য। আর ৫-১০টি কল আসে ইঁদুর পালন শেখার জন্য। বৃহৎ পরিসরে ইঁদুরের চাষাবাদ করার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে ইঁদুর বিক্রি বন্ধ করেছি। এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে আবার শুরু করব। নগরীর উপকণ্ঠ টাঙ্গনে দিতল ভবনের ওপর কয়েক হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে আরেকটি বড় খামার করার চেষ্টা চলছে।
করোনায় ইঁদুর নিয়ে বিপদে পড়ার ঘটনাও জানিয়েছেন তিনি। স্বল্প পরিসরে ইঁদুর পালনে কিছুটা সম্ভাবনা দেখলেও করোনাকালের পড়েছিলেন মহাবিপদে। করোনায় ইঁদুরের বিক্রি না থাকায় পড়েছিলেন অর্থসংকটে। প্রতিদিন খাবারের টাকার যোগান দিতে না পারায় প্রায় ৫০০টি ইঁদুর তার বাড়ির পোষা বিড়ালকে খাইয়ে দিতে হয়েছিল। তাতে যথেষ্ট কষ্টও পেয়েছিলেন তিনি।
এদিকে রাবির গবেষকরা জানান, সুইস অ্যালবিনো মূলত সুইজারল্যান্ডের ইঁদুর। ইঁদুরের জিনের সাথে মানুষের জিনের বেশ মিল থাকায় গবেষণাগারে প্রাথমিক ধাপে অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া এটি অন্যান্য ইঁদুরের মতন আক্রমণাত্মক ও বিধ্বংসী নয়। নানাবিধ গবেষণা কাজে এই ইঁদুর বেশ উপকারী। বায়োলজিক্যাল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সের যেকোনো গবেষণা কাজের প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষার জন্য সুইস অ্যালবিনো প্রজাতির এই ইঁদুর ব্যবহার করা হয়।
তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশে শুধু আইডিসিআরবি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঁদুরের চাষ করা হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ব্যক্তি উদ্যোগে ইঁদুর পালনে আগ্রহীদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তা বাংলাদেশের গবেষণাখাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
ইঁদুরের বংশবিস্তার নিয়ে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ। বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুরের চাষাবাদ ও পরিচর্যার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে মামুনের সুইস অ্যালবিনোর বাণিজ্যিকভাবে চাষ এটি প্রশংসনীয় ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। তবে মামুন যেহেতু বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর পালন করার চিন্তাভাবনা করছেন সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই বাসস্থান, পরিচর্যা, খাবার ও তাপমাত্রার বিষয়গুলো আরও বৈজ্ঞানিকভাবে মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে তার কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি তা দিতে প্রস্তুত।
ইঁদুর পালনের সম্ভনা ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সুইস অ্যালবিনো ইঁদুরের চাহিদা শুধু শিক্ষা ও স্বল্প সংখ্যক গবেষণাগারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এই ইঁদুরটি রাজশাহী কিংবা দেশের সব জায়গায় পালন শুরু করলে উদ্যোক্তারা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। কারণ এই ইঁদুরের প্রোডাক্টিভিটি বেশি। কোনোভাবে যদি এটি বাইরের পরিবেশে অ্যাডজাস্ট করে তাহলে পরিবেশের জন্যও ক্ষতি হতে পারে।
ইঁদুর নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে সালাউদ্দীন মামুন বলেন, শুধু রাবি নয় বরং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণারের জন্য ইঁদুর সরবরাহ করার ইচ্ছা আছে তার। আমি ইতোমধ্যে একটি বড় ঘর তৈরি করেছি। সেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইঁদুর পালন করব।
এফএ/জেআইএম