খেয়াঘাটের মাঝি এখন নোঙর ফেলতে চান স্থলে

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ১১:২৭ এএম, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ওপার থেকে আসছে ডাকছে- ‘ও খালা পার করে নিয়ে যাও’। নদীর এপার আর ওপার করতে করতে তার কেটে গেছে দীর্ঘ ৩০ বছর।

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার জয়ন্তী নদীর খেয়াঘাটের নারী মাঝি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নৌকা টানেন তিনি। উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর থেকে ২০০ গজ দূরে ধীপুর গ্রামের মৃত কালু ব্যাপারীর বড় মেয়ে মিলন নেছা (৫২)।

রোববার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, মিলন নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করছেন। ছোট-বড় সবাই তাকে খালা বলে ডাকছেন। একজন নদী পার হলে পাঁচ টাকা করে দিচ্ছেন তাকে। দুপুরের সময় লোক কম থাকায় ভাসমান নৌকায় বসে রান্না করছেন মিলন। কষ্টের জীবন হলেও মুখে যেন হাসি লেগেই আছে।

কথা হয় মিলন নেছার সঙ্গে। তিনি জানান, জয়ন্তী নদীর খেয়াঘাটে তার বাবা কালু ব্যাপারী মাঝির কাজ শুরু করেন।

jagonews24

মিলন নেছা মাঝির বয়স যখন ২২ বছর তখন তার বাবা মারা যান। তারা তিন বোন, তিন ভাই। ওই বয়সেই সংসারের হাল ধরতে মাঝির কাজ শুরু করেন মিলন।

মিলন মাঝি জানান, তিনি যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন তখন একজন মানুষ পার করলে এক টাকা করে পেতেন। এখন পাঁচ টাকা করে নদী পারাপার করেন। প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা আয় করেন। তাছাড়া দুই পারের কিছু মানুষ বছরে যা ফসল পায় তার একটি অংশ দিয়ে সহযোগিতা করেন মিলনকে।

বাবার পথ অনুসরণ করে বেছে নেয়া নৌকার মাঝির কাজে কোনোভাবে জীবন আর জীবিকা চালিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটছে মিলন নেছার। তবুও যেন হাল ছাড়ার পাত্রী নন তিনি। করোনাকালে কিছু সরকারি খাদ্যসামগ্রী পেয়েছেন। তাছাড়া কোনো সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পাননি তিনি।

মিলন নেছা মাঝি বলেন, আমার স্বামী রহম আলী সরদার ১৫ বছর আগে আমাকে ও দুই ছেলেকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। বড় ছেলে আব্দুল খালেক (২৬) বিয়ে করে আলাদা থাকে। আর আমি নদীর পাড়ে ছাউনি নৌকায় ছোট ছেলে আব্দুল মালেককে (২২) নিয়ে থাকি।

jagonews24

তিনি আরও বলেন, নৌকাতেই রান্না-খাওয়া, নৌকাতেই আমার বসবাস। ২২ বছর নৌকা পরাপার করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি। জীবনের শেষ এ সঞ্চয় দিয়ে ছয় শতক জমি কিনেছি। কিন্তু ঘর তুলতে পারিনি। বড় ইচ্ছা একটি ঘর হলে সন্তান নিয়ে থাকতাম।

মিলনের ছোট ছেলে আব্দুল মালেক বলেন, আমার মার বয়স হয়েছে। তবুও নদীতে নৌকা চালান। যে অর্থ পান, তা দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। মাঝে মাঝে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করি আমি। বড় কষ্টে চলছে আমাদের জীবন। সরকারিভাবে যদি একটি ঘর পেতাম মাকে নিয়ে সুখেই কাটতো দিনগুলো।

পায়েলসহ অন্যান্য স্কুল ছাত্রীরা বলেন, খালা অনেক ভালো। আমাদের নদী পার করে স্কুলে নিয়ে যায়। আবার দিয়ে যায়।

নৌকা পারাপার হওয়া গোসাইরহাট পৌরসভার সম্ভু ঘোষ (৬০) ও রুহুল আমিন সরদার (৩৫) বলেন, মিলন খালা সহজ-সরল মানুষ। তিনি এ ঘাটে বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীসহ দুই পারের মানুষ পারাপার করেন। আমরাও পারাপার হই। তাকে ছাড়া নদীর ওই ঘাট শূন্য লাগে। সরকার বা কোনো বৃত্তবান ব্যক্তি যদি তাকে একটি ঘর দিতো, তাহলে ভালো হতো।

jagonews24

সমাজসেবক নাজমুল হোসেন বলেন, ২৮-৩০ বছর দেখে আসছি মিলন নেছা মাঝি নৌকা পারপার করে জীবনযাপন করেন। তার বাবাও এই নৌকার মাঝি ছিলেন। এত নদী পাড় হয়েছি নারী মাঝি দেখিনি। এটা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।

গোসাইরহাট উপজেলা সমাজসেবা অফিসার নাজমুল হাসান বলেন, মিলন নেছার নৌকায় আমি নদী পারও হয়েছি। তিনি যেহেতু ভাতার আওতাভুক্ত হননি, তাই তাকে বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্ত ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। সেক্ষেত্রে একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রত্যয়নপত্র লাগবে।

গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও গোসাইরহাট পৌরসভার প্রশাসক মো. আলমগীর হুসাইন বলেন, মিলন নেছা একজন নারী নৌকার মাঝি জানতাম না। বিষয়টি জেনে পৌরসভার পক্ষ থেকে তার খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। তার যেহেতু স্বামী নেই, তাই বিধবা ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করবো। যদি বাড়ি না থেকে থাকে, তাহলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের 'খ' তালিকাভুক্ত যারা ভূমিহীন আছে তাদের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করবো।

ছগির হোসেন/এসএমএম/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।