জমি কেটে নিচ্ছে ইজারাদার, রেখে যাচ্ছে নদীভাঙনের ভয়
কুষ্টিয়ার খোকসায় সরকারের তিনটি আবাসন প্রকল্পের দেড়শ মিটারের ভেতর থেকে ফসলসহ জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন বালু মহালের ইজারাদার। ফলে আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো নদীভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও ইজারাদারের এস্কেভেটর পোড়ানোর মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নিরাপরাধ ৩০ ভূমিহীন।
গড়াই নদীর ভাঙন উপদ্রুত ওসমানপুর ইউনিয়ন হিজলাবট ও খানপুর মৌজায় হিজলাবট দ্বিপচর আশ্রয়ন প্রকল্প। প্রায় দুই যুগ ধরে ১৭০টি পরিবার এ আবাসনে বসবাস করছে।
এর পূর্বপাশে জেগে ওঠা চরে খোকসা ইউনিয়নে হিলালপুর গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প। এখানেও প্রায় ৫৫টি পরিবার বসবাস করে। এবার মুজিববর্ষের ভূমিহীন ও আশ্রয়হীনদের আবাসন প্রকল্পে ৩০ পরিবারের জন্য সেমিপাকা বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে মোড়াগাছা হেলিপ্যাডের জমিতে।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইজারাদার প্রথমে নদীর চর থেকে বালু কাটতে শুরু করেন। কিন্তু হেলিপ্যাডের ওপর মুজিববর্ষের আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা মাটির ট্রাক চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা নতুন করে আবাসন প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রামে যাওয়ার একমাত্র রাস্তার ব্রিজের ১০ মিটারের ভেতর থেকে ফসলি জমি কাটা শুরু করেন। এ নিয়ে ভূমিহীনরা আপত্তি তুলেছেন। তারা নালিশ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে যান। তবে তাতেও কাজ হয়নি।
সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শনের পর ফসলি জমি কাটার মাত্রা চরমে পৌঁছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। ট্রাকে করে এ মাটি পরিবহন করা হচ্ছে মুজিববর্ষের আবাসন প্রকল্পের ওপর দিয়েই।
সম্প্রতি এক রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা ইজারাদারের একটি মাটি কাটা যন্ত্র পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ১০ জন ভূমিহীনসহ বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে জেল হাজতে আছেন ভূমিহীন শামসুল শেখ।
একদিকে ইজারাদারের সন্ত্রাসী বাহিনী অন্যদিকে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ভূমিহীন কাজেম, ছামিরুল, রাজন, জহিরুলসহ ৩০ জন। অনাহারে অর্ধাহারে জীবন পার করছেন এসব ভূমিহীনদের পরিবারের সদস্যরা।
উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মোড়াগাছা মৌজায় গড়াই নদীর তীরে জেগে ওঠা চরের খাস জমিতে এরশাদ সরকারে আমলে হেলিপ্যাডটি তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে এখানে নির্মাণ করা হচ্ছে মুজিববর্ষের আশ্রয়ন প্রকল্প। এর থেকে দুইশ মিটারের ভেতরে ওসমানপুন ইউনিয়নের হিজলাবট দ্বীপচর আশ্রয়ন প্রকল্প। এর পূর্ব পাশে হিলালপুর গুচ্ছগ্রাম।
এসব আবাসন ও গুচ্ছগ্রামের মধ্যে সংযোগ রক্ষায় গত বছর ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজ পার হয়েই দ্বীপচরের পূর্বদিকে প্রায় অর্ধশত বিঘা জমিতে ভূমিহীনরা ফসল আবাদ করে আসছেন। এসব জমি পার হয়ে গড়াই নদীর খানপুর হিজলাবট মৌজার বালু মহাল। যা সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের দফতর থেকে ইজারা দেয়া হয়েছে।
এ সুযোগে ইজারাদার এখন বালু মহালে না গিয়ে নদী তীরের কৃষকের ফসলি জমি থেকে মাটিসহ ফসল কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নদীভাঙনের হুমকীর মুখে পড়ছে এসব আবাসন ও আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারী ভূমিহীন পরিবারগুলো।
সর্বশেষ শনিবার সকালে জমির ফসলসহ মাটি কাটা বন্ধের দাবিতে গড়াই নদীর চরে জমায়েত হন ভূমিহীন নারী পুরুষ। তারা আশ্রয়ন রক্ষায় দাবি জানান।
সেখানেই কথা হয় ইজারাদারের দায়ের করা মামলায় আটক শামসুল শেখের স্ত্রী আনেচা খাতুনের সাথে। তিনি বলেন, ইজারাদারের মিথ্যা মামলায় স্বামী জেলে আটকা। ছোট ছেলেটার অসুখ। নদীতে মাছ ধরে তাদের সংসার চলে। বর্তমানে তার বাড়িতে খাবার নেই।
তিনি দাবি করেন, ইজারাদার মাসুদের ব্যক্তিগত শত্রুরা তার মাটিকাটার মেশিন পুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর মামলার শিকার হচ্ছে সাধারণ ভূমিহীনরা। তিনি ফসলি জমিকাটা বন্ধ করে নদীর বালু চর থেকে বালু তোলার দাবি বরেন।
বালু মহালের ইজাদার মাসুদ জানান, দীর্ঘদিন বালু মহাল ইজারা না হওয়ায় দ্বীপচরের আবাসন প্রকল্পের একাংশে মাটি ও বালু জমে উঁচু চরে পরিণত হয়। সেখানে কৃষকরা ফসল ফলাতো সত্য কিন্তু বালু মহালের রাস্তা না পেয়ে প্রশাসনের নির্দেশে সেখান থেকে বালুমাটি কাটা হচ্ছে।
তিনি ফসল তছরুপের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু তার একটি এস্কেভেটর পুড়িয়ে দেয়ার পর তিনি মামলা করেছেন। এছাড়া যারা মোবাইলে ও সামনা সামনি হুমকী দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন।
ভূমিহীন কৃষকের ক্ষতির কথা ভেবে ইজারাদার ঘাট বন্ধের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলেছিলেন কিন্তু প্রশাসন তার প্রস্তাবে রাজি হননি বলেও তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইসাহক আলী জানান, তিনি ট্রেনিং থেকে স্টেশনে ফিরছেন। বালুমহালে আসলে কী হয়েছে তা না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দীন বলেন, বালু মহালে গাড়ি নেয়ার জন্য ইজাদার রাস্তা বানানোর চেষ্টা করছে। তবে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত বালুমহালের ওপর পলির স্তর জমে যাওয়ায় সেখানে কিছু লোক চাষাবাদ করত। ব্রিজ বা আশ্রয়ন প্রকল্পের যাতে ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে তিনি ইতোমধ্যেই ইজারাদারকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
আল-মামুন সাগর/এফএ/এমকেএইচ