বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাইলেন সরকারি ঘর পাওয়া সাবেক সেই এমপি
দাদা হালিম উদ্দিন ছিলেন ভারতের হুগলী মহসীন মাদরাসা থেকে ১৮৮৪ সালে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ গফরগাঁওয়ের প্রথম পাস করা মৌলভী। তার ছেলে আব্দুছ ছালাম ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাস করেন। নাতি এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ ও ১৯৮৬ সালে ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসন থেকে জাতীয় পার্টির (জাপা) হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অজানা কারণে নিজের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে হয়েছেন নিঃস্ব।
তৃতীয় স্ত্রী ও ৯ বছরের ছেলেসহ ছোট্ট খুপরি ভাড়া বাসায় তার বসবাস। নিজের শেষ সম্বল বলতে কিছু হাঁড়ি-পাতিল, একটি লেপ ও একটি তোশক। ঘরের মেঝেতেই তার বসবাস, নেই একটি খাটও।
এবার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন দুবারের এমপি হয়েও গৃহহীনদের ঘর পেয়ে। তবে তার মতো ব্যক্তির গৃহহীনদের ঘর নেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না প্রতিবেশীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে নির্বাচিত এক সময়ের দাপুটে সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ (৮০) অর্থাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জজ মিয়ার দাবি, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। এ বয়সে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, নিজের শিশুসন্তানকে মানুষ করতে হলে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তার প্রয়োজন।
গফরগাঁও পৌরসভায় ভাড়া বাসায় খোঁজ নিতে গেলে আক্ষেপ করে সাবেক এমপি জজ মিয়া বলেন, জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পালিত মেয়ে নাজুকে ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন এনামুল হক জজ। পরে ১৯৮৩ ও ১৯৮৬ সালে ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে দুবার সংসদ সদস্য হন তিনি। এক সময় তার গফরগাঁও পৌর শহর ও ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি ছিল। কিন্তু সর্বশেষ পৌর শহরে ১২ শতাংশ জমি মসজিদের নামে লিখে দিয়ে এক রুমের ভাড়া বাসায় থাকছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। খাট কেনার সামর্থ্য না থাকায় মেঝেতেই ঘুমান তিনি।
প্রথম স্ত্রী নাজু এক মেয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রী নাছিমা হক ঢাকার পুরানা পল্টন ও মিরপুর কাজী পাড়ায় দুই সন্তান নিয়ে দুটি বাড়িতে থাকেন। সহায় সম্পদ যা ছিল সবই এই দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে লিখে দিয়েছিলেন এনামুল হক।
বর্তমানে তিনি তৃতীয় স্ত্রী রুমার সঙ্গে পৌর শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভাড়া বাসায় ৮ বছরের সন্তান নুরে এলাহীকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে এনামুল হক বলেন, ‘আমি ক্ষমতায় ছিলাম, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। আমি তখন ইচ্ছা করলেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিতে পারতাম। কিন্তু নিইনি। আমি কোনো দিন ভাবতেও পারিনি শেষ বয়সে এসে আমার এমন অবস্থা হবে।’
মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পে আবেদন করলে শনিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে তিনিসহ ২০০ জনকে ঘরের চাবি ও দলিল বুঝিয়ে দেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে যত আলোচনা-সমালোচনা। জজ মিয়া বলছেন, আল্লাহ চাইলে তিনি ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরেই উঠবেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আটজনের একটি দল নিয়ে চলে যাই ভারতের মেঘালয়ে। সেখান থেকে এক মাস পরে ফিরে আসি কিশোরগঞ্জের ফুলতলায়। নির্দেশ আসে হোসেনপুর হয়ে নদী পেরিয়ে গফরগাঁও অপারেশনের। একটি বাজারের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কখনো রাস্তায় কখনো বাড়িঘরের ভেতর দিয়ে যাই। গন্তব্য কালীবাড়ির (বর্তমান গফরগাঁও ইমামবাড়ি) কাছে একটি পাটক্ষেত। সেখানে এসএলআর বিনিময় হবে বিকেল ৪টায়। সময় মতো চলে আসি হোসেনপুর হয়ে নদী পেরিয়ে। হেঁটে চলে আসি গন্তব্যে।’
‘হঠাৎ দেখি ১০-১২ বছরের একটি ছেলে আমাকে ইশারায় ডাকছে। কাছে গেলাম। একটি চিরকুট হাতে দিয়ে ছেলেটি উধাও। লেখা ছিল, তাড়াতাড়ি কেটে পড়ো। সমস্যা আছে। নতুন জায়গার কথা লেখা ছিল চিরকুটে। সেখানে পরদিন সন্ধ্যায় যেতে হবে। হঠাৎ পাকবাহিনীর উপস্থিতি টের পাই। পালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়লাম।’
‘যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি আমি গফরগাঁও ডাকবাংলোর আমগাছে ঝুলে আছি। হঠাৎ কানে ভেসে এল এটা মৌলানা সাহেবের লোক। আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। যিনি আমাকে ছাড়িয়েছেন তার কাছে জীবন বাঁচানোর জন্য আমার পরিবার কৃতজ্ঞতা জানাল।’
এনামুল হকের তৃতীয় স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ‘আমি একজন সাবেক এমপির স্ত্রী হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে উঠতে পারি না। পৌরসভার ভেতরে যদি কোনো ব্যবস্থা করে দিত তাহলে খুব ভালো হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেও হয়তো ছেলেকে মানুষ করতে পারতেন।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনামুল হক এক সময় অনেক অর্থ সম্পদের মালিক ছিলেন। দুবারের এমপিও ছিলেন। তার এখন কিছুই নেই। থাকার একটু জায়গা ছিল। তাও মসজিদের নামে দান করেছেন। তার এমন দুরবস্থা দেখে তাদের খুব খারাপ লাগে।’
একজন বলেন, ‘তিনি একজন সাবেক এমপি ও সম্মানী ব্যক্তি৷ তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে ওঠা অপমানজনক। সরকার যদি তার প্রতি একটু নজর দেয় তাহলে হয়তো সম্মানের সঙ্গে তিনি চলতে পারবেন।’
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ছাড়াও তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে। তাছাড়া তিনি কিছু ফার্নিচার আবদার করেছিলন। তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র ইকবাল হোসেন সুমন বলেন, ‘মানবিক দিক বিবেচনা করেই স্থানীয় সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল ২৩ জানুয়ারি তাকে একটি ঘর বুঝিয়ে দেন। তাছাড়া তার দৈনন্দিন কিছু চাহিদা আছে। সেগুলো সাধ্যমতো ব্যবস্থা করা হবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ ঘরগুলো আশ্রয়হীনদের জন্যই বরাদ্দ করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে যারা নির্বাচন কমিটিতে আছেন, তাদের সুপারিশেই তাকে ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে। আমরা সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।’
মঞ্জুরুল ইসলাম/এসআর/এমকেএইচ