ভুট্টায় ভাগ্য বদলেছে চরবাসীর
লালমনিরহাটের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন কৃষি। তার মধ্যে অন্যতম রবিশস্য ভুট্টা, যা সম্প্রতি এ অঞ্চলের ব্র্যান্ডিং পণ্য বলে পরিচিতি পেয়েছে। ভুট্টা চাষ বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা।
এক সময় চরে মানুষ না খেয়ে কষ্টে দিন পার করত। কিন্তু গত ২৫ বছরে চর এলাকায় দৃশ্যপট বদলে গেছে। বালু মাটিতে ভুট্টা চাষ করে বদলে গেছে তাদের জীবন। গ্রামগুলোতে খড়ের ঘরের পরিবর্তে উঠেছে আধাপাকা ঘর। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না তাদের।
লালমনিরহাটে এখন ভুট্টাই প্রধান অর্থকরী ফসল। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টা গাছ ও সবুজ পাতা উন্নতমানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলাজুড়ে সবুজ পাতায় স্বপ্ন বুনছেন ভুট্টা চাষিরা। ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে। কোথাও তরতাজা হয়ে গাছ বেরিয়ে আসছে। কম সময়ে ও ভূগর্ভ স্তরের পানি কম ব্যবহার করতে রবিশস্য আবাদের জন্য কৃষকরা ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন।
তিস্তা ও ধরলা নদীর বুকে জেগে উঠেছে একাধিক চর। সেই চরে গড়ে উঠেছে বসতি। চলছে নানা জাতের ফসলের চাষাবাদ। তিস্তার বুকে সবচেয়ে বেশি চর জেগেছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায়।
অন্যদিকে ধরলার বুকে সবচেয়ে বেশি চর জেগে উঠেছে লালমনিরহাট সদর উপজেলায়। এসব চরের বুকে মানুষের বসতির পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ শুরু হয়েছে।
ধরলা নদীতে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাঘাটে পাঁচটি চর জেগে উঠেছে। এর মধ্যে দুটি চরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। তাছাড়া ধরলা, রত্না ও সানিয়াজান নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদীর বুকে বোরো ধান চাষের পাশাপাশি ভুট্টা চাষের ধুম পড়েছে। ভুট্টা চাষের ধুম পড়েছে তিস্তার নদীর বুকেও।
তিস্তার চরাঞ্চলে এ বছর আবহাওয়া অনুকূল ও ভুট্টায় পোকার আক্রমণ না থাকায় কৃষকরা বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় প্রায় ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া আলুর জমিতে ভুট্টার আবাদ করলে খরচ একটু কম হয়। ভুট্টার পর ওই জমিতে ধান ও পাট আবাদও হয়।
প্রতি বিঘায় ভুট্টার ফলন আসে ৩৫-৪০ মণ। এছাড়া কমপক্ষে ২০-২৫ মণের মতো ফলন হয়। বাজারে নতুন ভুট্টার মণ ৬০০-৭০০ টাকা।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীতে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, গোড্ডিমারী, সিন্দুর্ণা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, তুষভাণ্ডার, কাকিনা ইউনিয়ন, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন, লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুণ্ডা, খুনিয়াগাছ ও রাজপুর ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় ৬৩টি জেগে ওঠা চরে ভুট্টার চাষ হচ্ছে।
কৃষকরা জানান, প্রতি বছর ছয় মাস পর পর ভুট্টা চাষ শুরু হয়। ভুট্টা চাষের শুরুতেই দাম বেড়ে যায় সার ও বীজের। এতে সাধারণ কৃষকরা স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের সুদ নিয়ে চাষ শুরু করেন। ফলন ভালো হলে ভালো, না হলে পথে বসতে হয় কৃষকদের।
এদিকে কৃষি ব্যাংকগুলো ভুট্টা চাষের ওপর ঋণ দিলেও সেই ঋণ তুলতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় কৃষকদের। ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু হলে স্থানীয় বাজারে ভুট্টার দাম নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে এলাকার বেকার যুবকদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করে সচেতন মহল।
কৃষি বিভাগের পাশাপশি ভুট্টা চাষিদের স্বাবলম্বী ও বাজার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও।
চলতি মৌসুমেও এ অঞ্চলের কৃষকরা রেকর্ড পরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। ২০১৯ সালের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ জমিতে এবার ভুট্টা চাষ করেন এখানকার কৃষকরা। বিশেষভাবে লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ভুট্টা চাষ করেন তারা।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে ২০২০-২১ অর্থবছরে রবি মৌসুমে ৩০ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। চলতি অর্থবছর ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ আরও প্রায় দুই হাজার হেক্টর বেড়েছে। প্রতি বছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
এ বছর ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১০০ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এ অঞ্চল থেকে প্রায় দুই লাখ ৮২ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়।
সরেজমিনে হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান এলাকায় কৃষক আফজাল হোসেন জানান, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কৃষি বিভাগের সহায়তায় উন্নতজাতের বীজ আবাদের ফলে আগের চেয়ে ভুট্টার ফলন এখন দ্বিগুণ। বর্তমানে প্রতি একর জমি থেকে প্রায় ১০০-১৪০ মণ ভুট্টা পাওয়া যায় এবং এর জন্য খরচ পড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা। একরপ্রতি খরচ বাদে লাভ থাকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা।
সানিয়াজান এলাকার নিজ শেখসুন্দর গ্রামের শাহাজাহান মন্ডল জানান, এ এলাকায় মানুষের অনেক কষ্ট ছিল। দিনমজুরি করে পরিবার নিয়ে তাদের চলতে হতো। ভুট্টার চাষ শুরু হলে এখানকার মানুষের দিন পরিবর্তন হতে শুরু করে। ভুট্টা চাষের পর থেকে আমরা অনেক উন্নত।
বড়খাতা বাজারের ভুট্টা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, আগাম জাতের ভুট্টার অধিক ফলন, দামও বেশি। প্রতি মণ ভুট্টা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়।
তিনি আরও বলেন, এ এলাকার ভুট্টা কিনতে ঢাকা, কুষ্টিয়া, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসেন। তাই কৃষকরা ভুট্টার দামও পান।
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, ভুট্টা চাষের সময় কৃষকদের জমিতে ব্যাপকভাবে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। চলতি মৌসুমে শীতের কারণে সেচ কম দেয়ায় চাষিদের খরচও কম হবে। তিনি তিস্তার চরাঞ্চলসহ জেলাজুড়ে ভুট্টার বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. শামসুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, লালমনিরহাট জেলাজুড়ে ব্যাপক ভুট্টাচাষ হয়েছে। বিশেষ করে নদীর চরগুলোতে ভুট্টার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। জেলাজুড়ে আমাদের কৃষি অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ভুট্টাচাষের জন্য কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
এফএ/এমকেএইচ