কম্বল ছাড়াই রাত কাটছে স্টেশনের অর্ধশতাধিক ভিক্ষুক-গৃহহীনের
রাজশাহীজুড়ে কয়েকদিন ধরে আচমকা উত্তরের বাতাসে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। ঘন কুয়াশা ও হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত উত্তরের জনজীবন। এমনই এক বৈরী পরিবেশে সারিবেঁধে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন অর্ধশত গৃহহীন ফকির-মিসকিন। দিনশেষে স্টেশনের খোলা আকাশই যেন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। তীব্র শীতেও স্টেশনের ভেতরে মেলে না স্থান।
শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজশাহী স্টেশনের সামনে বাইক ও মাইক্রোস্ট্যান্ডে সারিবদ্ধ হয়ে প্লাস্টিকের চট ও পুরোনো জীর্ণশীর্ণ কিছু কাপড় জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায় অর্ধশতাধিক ভিক্ষুক ও গৃহহীন মানুষকে।
খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর নিদারুণ কষ্ট দেখে প্রতিবেদক সামনে এগোতেই রিতা নামের এক বৃদ্ধা করুণ স্বরে বললেন, ‘কম্বল-টম্বল দিবা নাকি গো বাবা? খুব শীত রে বাপ, একটা কম্বল বা জ্যাকেট থাকলে দাও, পরে বাঁচি। এই শীতে আর থাকতে পারছি না। খুব কষ্ট। একটা কম্বল দিলে তোমার জন্য নামাজ পরে দোয়া করব বাপ আমার।’
বৃদ্ধা মোছা. রিতার (৫৭) বাড়ি চুয়াডাঙ্গার নূর নগর কলোনিতে। স্বামী নায়েব আলী (৭২)। তিন সন্তানের জননী তিনি। বড় ছেলে ইমরান (৩৮), মেজো ছেলে সুমন (৩০) ও ছোট ছেলে ভুটান। ভোটের দিনে হয়েছিল তাই ছোট ছেলের নাম ‘ভুটান’ রেখেছেন তিনি। কিন্তু এই তিন ছেলের কেউই তাদের ভরণ-পোষণ দেন না। অথচ, সম্পত্তি লিখে নেয়ার জন্য ছেলেরা চাপ দেন তাদের। তাই সন্তানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ স্বামী-স্ত্রী রাজশাহীর পথে প্রান্তরে এসে ভিক্ষা করে জীবন চালাচ্ছেন।
নীলফামারীতে বাড়ি ১২ বছরের কিশোর শাহিনের। স্টেশনে পেপার ও বেলুন বেচে চলে তার জীবন। শাহিন জানায়, ছোটবেলায় তার বাবা মাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেন। দু-এক বছর পর মাও মারা যান। আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ নেই। ভাগ্যচক্রে ঘুরেফিরে রাজশাহী স্টেশনে ঠিকানা গাড়ে সে।
সে আরও জানায়, ছোট মানুষ বলে কেউ তাকে কম্বল দিতে চায় না। দোষারোপ করে বলে, কম্বল বা জ্যাকেট দিলেই হয়তো সে বেচে দেবে। তাই পরনে একটি ফুলহাতা শার্ট ও গেঞ্জি পরেই তার দিন যাচ্ছে এই হাড়কাঁপানো শীতে। গরম কাপড় না দিলেও গালমন্দ ঠিকই দেয় বলে জানায় সে।
রাজশাহীর লোকমানপুরের বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহেদ (৭১)। দুই মেয়ের জনক তিনি। দুই মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গ্রামে কোনো কাজ না পাওয়ায় চার বছর ধরে তিনিও রাজশাহীর স্টেশনে এসে দিনযাপন করেছেন। এই শীতে পেয়েছেন একটি মাত্র কম্বল। তাতেও শীত যায় না। তার আকুতি, একটা কম্বল বা জ্যাকেট পেলে শীতের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো।
স্টেশনের হযরত (১৫) পাগল হঠাৎ এসে হাজির প্রতিবেদকের সামনে। তার অভিযোগ, ‘ওই পারের চারজন আমাদের কম্বল নিতে দেয় না। কম্বল যারা দিতে আসে তাদের ওরা ছিঁড়ে খায়, আর আমাদের হুমকি দেয়। কম্বলও কেড়ে নেয়, গাল দেয়। খুব খারাপ ওরা।’
স্টেশনেই আরেক বৃদ্ধা ভিক্ষুক জুলেখা বেগম (৬৩)। রাজশাহীর গোড়াগাড়ী উপজেলার প্রেমতলীতে বাড়ি তার। স্বামী মাইনুল ইসলাম। বিয়ে করে চলে গেছেন বহু আগেই। মানুষের বাসায় কাজ করে বড় মেয়ে মনুয়ারা (৪০) ও মেজো মেয়ে সাথীকে (৩৫) বিয়ে দিয়েছেন। বয়স হওয়ায় কাজ করতে পারেন না আর। তাই বাধ্য হয়ে ছোট ছেলে ইসমাইলকে (২৩) গ্রামের বাসায় রেখে প্রায় একযুগ ধরে রাজশাহী এসে দ্বারে দ্বারে ঘোরেন তিনি। সেই দিয়েই চলে ছোট ছেলের পড়াশোনার খরচ ও নিজের জীবন। ছেলে এখন প্রেমতলী কলেছে ডিগ্রি পড়ুয়া ছাত্র।
পাগল হযরতের মতো জুলেখা বেগম ও অন্যদেরও একই অভিযোগ। তারা বাইরে থেকে এসেছেন, তাই কয়েকজন নগরীর কলোনি থেকে আসা নারী তাদের খারাপ আচরণ করেন। কম্বল নিতেও দেন না। কেউ কম্বল দান করলেও তারা জোর করে কেড়ে নেন।
ভিক্ষুক জুলেখা বেগম জানান, খোলা আকাশে শিশিরে তাদের কম্বল ও কাপড়-চোপড় ভিজে যায়। শীতের কাঁপুনি সহ্য হয় না। তারপরও থাকতে হয় সেখানে। অন্য জায়গার চেয়ে নিরাপদ থাকা যায় সেখানে। কিন্তু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তাদের শুতে দেন না নিরাপত্তাকর্মীরা। করোনাভাইরাস হওয়ার পর থেকেই তাদের শুতে হয় খোলা আকাশের নিচে।
এদের বিষয়ে জানতে চাইলে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মমিন বলেন, ‘সকাল-সন্ধ্যা প্রতিদিনই স্টেশনে আসা-যাওয়া করি। তাদের এই করুণ অবস্থা দেখে মন খুব কেঁদে ওঠে। কিন্তু নিয়মের বাইরে আমরা কেউ যেতে পারি না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তারা স্টেশনের ভেতরে থাকতে পারবে না।’
এদিকে উত্তরে শৈত্যপ্রবাহ, জলবায়ু ও তাপমাত্রার বিষয়ে আবহাওয়াবিদ মো. রহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে হিম বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেলেই শীতের প্রকোপও বাড়তে থাকে। এই হিম বাতাসের তীব্রতার কারণে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু শৈত্যপ্রবাহই নয়, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাতেরও সম্ভাবনা রয়েছে।’
প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষু ও কিছু যাত্রীদের রাত্রিযাপন করতে না দেয়ার বিষয়ে রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার আব্দুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাকালীন রেল মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা জারি করার কারণে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কোনো প্রকারের মানুষ অবস্থান করতে পারবে না বলে নির্দেশনা রয়েছে। যে কারণে তাদের প্ল্যাটফর্মের ভেতরে থাকতে দেয়া হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা প্ল্যাটফর্মে থাকলে যাত্রীদের যাওয়া-আসায় অনেক সমস্যা হয়। তাছাড়া স্টেশনের ভেতরে থাকলে তারা যেখানে-সেখানে কাশ-থুতু ফেলে ও খাওয়া-দাওয়া শেষে ময়লা আবর্জনা করেন। তাছাড়া স্টেশনের বাথরুম ব্যবহার করেও নষ্ট করেন। তাই তাদের ভেতরে থাকা নিষেধ।’
এসআর/এমএস