তীব্র শীতে রসে মেতেছেন গাছিরা
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েছেন জমসেদ আলী। খালি পায়ে তরতরিয়ে উঠে পড়ছেন খেজুর গাছে। নামিয়ে আনছেন হাঁড়িভর্তি রস। গেল ১৫ বছর ধরেই ‘গাছি’ হিসেবে এই কাজ করছেন জমসেদ। তার দাবি এবার শীত পড়ছে বেশি। তাই গাছে গাছে রসও বেশি।
জমসেদ আলীর বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শিবপুর গ্রামে। নিজের কোনো গাছ নেই তার। প্রতিবার মালিকদের কাছ থেকে গাছ ভাড়া নেন। এবার মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সব কাজ জমসেদই করবেন। অর্ধেক রস মালিকের, অর্ধেক জমসেদের। মালিকের নাম আবদুল কুদ্দুস।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল ৭টার দিকে শিবপুর এলাকায় রস নামাচ্ছিলেন জমসেদ। আবদুল কুদ্দুস হাঁড়ি থেকে সেসব রস জারকিনে ভরতে সহায়তা করছিলেন।
কুদ্দুস জানালেন, তার গাছের সংখ্যা ৩০টি। গতবছর বড়জোড় ৫০ থেকে ৬০ লিটার রস পেয়েছেন। এবার এসব গাছে রস হচ্ছে কমপক্ষে ৮০ লিটার। তারা দুজন রস ভাগ করে নেন। এসব রস থেকে দু’জনেরই বাড়িতে দৈনিক কমপক্ষে সাত কেজি গুড় হয়। সপ্তাহের শনিবার তারা হাটে নিয়ে গুড় বিক্রি করেন।
আবদুল কুদ্দুস বলছিলেন, যে বছর বৃষ্টি বেশি হয় সে বছর গাছে রসও বেশি হয়। আবার বেশি শীত পড়লেও গাছে গাছে রসের পরিমাণ বাড়ে। এবার বৃষ্টিও বেশি হয়েছে, শীতও বেশি পড়ছে। তাই রসের পরিমাণও বেশি। শীত আর কুয়াশা যত বাড়ে রসও তত মিষ্টি হয়।
জমসেদ আলী একটার পর একটা গাছে উঠছিলেন। রসভর্তি একটা হাঁড়ি নামিয়ে আনার সময় আরেকটা লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। কোনো কিছুর সহায়তা ছাড়াই গাছে ওঠার বিষয়ে বললেন, ‘এসব কাজে অভিজ্ঞতা লাগে। অভিজ্ঞতা ছাড়া হয় না। সারাবছর আমি গাছেই উঠি। ক’দিন পর আম গাছে উঠে স্প্রে করব। এটাই আমার কাজ।’
এদিকে চারঘাটের লালমুনতলা গ্রামের গাছি সিরাজুল ইসলামের রস নামানোর কাজ ভোর সাড়ে ৬টার আগেই শেষ। সাইকেলে রসভর্তি দুটি জারকিন নিয়ে তিনি বাড়ির পথ ধরেছেন। পথেই কথা হয় তার সাথে।
জানালেন, তারও নিজের কোনো গাছ নেই। ৩০টি গাছ ইজারা নিয়েছেন মালিকের কাছ থেকে। প্রতিটি গাছের জন্য দিতে হয়েছে ১২০ টাকা। সিরাজুল ইসলাম কখনও রস পরিমাপ করে দেখেননি। তবে ৩০ গাছের রস দিয়ে প্রতিদিন তার বাড়িতে ৭ থেকে ৮ কেজি রস হয়।
সিরাজুল বলেন, গত বছর ৩০টা গাছের রসে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কেজি গুড় পেয়েছি। এবার বেশি হচ্ছে। রস বেশি হচ্ছে বলেই গুড় বেশি।
কুয়াশায় ঢাকা ভোরে গাছিরা রস নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর ব্যস্ততা শুরু হয় নারীদের। বড় তাওয়ায় রস ঢেলে শুরু হয় জ্বাল দেয়া। তাওয়ায় রস শুকিয়ে লালিগুড় না হওয়া পর্যন্ত জ্বাল দেয়া হতেই থাকে।
সোমবার সকালে গাঁশিবপুর গ্রামে বাড়ির সামনে এই কাজই করছিলেন আসিয়া বিবি (৫৫)। তিনি জানালেন, তার ছেলে জনাব আলী রস আনেন। এবার ১৮টি গাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০ লিটার রস পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন তার বাড়িতে সাড়ে ছয় থেকে সাত কেজি গুড় উৎপাদন হচ্ছে।
আসিয়া বিবির আরেক ছেলে আবু সাঈদেরও একই কথা। যত শীত, তত রস। এবার বেশি শীত পড়ার কারণে রস পাওয়া যাচ্ছে বেশি।
রাজশাহীর চারঘাট, পুঠিয়া ও বাঘা উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড় তৈরি হয়। কিন্তু খেজুর গুড়ে মেশানো হচ্ছে চিনি। বিষয়টি অকপটেই স্বীকার করলেন গাঁশিবপুর গ্রামের আবু সাঈদ।
তিনি বলেন, ১০ লিটার রসে যদি পাঁচ কেজিও চিনি মেশানো হয় তাহলে গুড়ের উৎপাদন পাঁচ কেজিই বাড়বে। ফলে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে বেশি লাভ হবে।
কিন্তু গুড়ে চিনি মেশানোর জন্য বেপারীরাই দায়ী বলে জানালেন তিনি। চিনি না মেশানো গুড় থাকে আঠালো। এই গুড় বেপারীরা নিতে চান না। তারা কড়কড়ে ফ্রেশ গুড় চান। বাধ্য হয়ে গাছিরা রসে চিনি মেশান।
শুধু চিনি মিশিয়ে দিলে রঙ সাদা হয়ে উঠবে। তাই গুড়ের রঙ লাল রাখতে এক প্রকার চুনও মেশাতে হয়। এতে গুড়ের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। খেজুর গুড়ের আর সেই ঘ্রাণ থাকে না। এই গুড় বাজারে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়।
তবে কেউ যদি আগে থেকেই অর্ডার দেন যে তিনি চিনিছাড়া গুড় নেবেন, তাহলে সেটাও বানিয়ে দেয়া হয়। এটির কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, আসল গুড়ের চাহিদাই আলাদা। বেশি লাভের আশায় গাছিরাই গুড়ে চিনি মেশান। তারা বন্ধ করে দিলেই পারেন। রাজশাহীর গুড়ের সুনাম ধরে রাখতে এটা বন্ধ করা হবে। কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা দেখব।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, রাজশাহীতে খেজুর গাছের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। এসব গাছ থেকে শীত মৌসুমে প্রায় ৮ হাজার টন গুড় উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ আছে চারঘাট উপজেলায়। সেখানে গাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৯৬ হাজার।
এছাড়া বাঘায় ২ লাখ ৯৯ হাজার এবং পুঠিয়ায় ৮৫ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে ৭৮ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে তা শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এফএ/এমকেএইচ